রুই-মাছ

রুই (Rohu Carp)

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এসব নদীতে এমনকি খালে, বিলে, পুকুরে রয়েছে হাজারো রকমের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের মাছ। তাই এদেশে জন্মানো প্রতিটি মানুষের সাথেই মাছ সরাসরিভাবে জড়িত। বাংলাদেশ ও ভারতে বহুল পরিচিত  ও সুস্বাদু মাছের মধ্যে রুই মাছ অন্যতম। 

রুই  মাছের ইংরেজি হচ্ছে  Rohu Carp; এবং  বৈজ্ঞানিক নাম: Labeo rohita । আন্তর্জাতিকভাবে রুই মাছের নাম বলা হয়ে থাকে রোহু। স্থানীয় নাম রুই, রোহিতা, রুহিত, রাউ, নলা, গরমা, নওসি। 

রুই মাছের সাধারণ বৈশিষ্ট্য:

  • অন্তঃকঙ্কাল অস্থি দ্বারা তৈরি 
  • মস্তক আঁইশ বিহীন 
  • অতিরিক্ত শ্বসন অঙ্গ বিহীন 
  • দাঁত বিহীন চোয়াল  

রুই মাছের শ্রেণী বিন্যাস: 

Phylum : Chordata

Subphylum: Vertebrata

Class : Actinopterygii

Order :Cypriniformes

Family : Cyprinidae

Genus : Labeo

Species:L.rohita 

রুই মাছের খাদ্যাভ্যাস:

  • প্ল্যাঙ্কটন জাতীয় খাবার যেমন ডেস্‌মিড, ফাইটোফ্লাজিলেট, শৈবাল রেনু ইত্যাদি খায় (আঙ্গুলিপনা দশায়)
  • প্রধানত শাকাশি (তরুন ও পূর্ণবয়স্ক মাছ) 
  • খাবার পিষে ফেলতে সাহায্য করে ধারালো কর্তন আল
  • অতিক্ষুদ্র প্ল্যাঙ্কটনও ছেঁকে খায়( ফুলকা র‍্যাকারের সাহায্যে)

রুই মাছের বাহ্যিক গঠন

রুই মাছের দেহ তিনভাগে বিভক্ত। যথা:

  • মাথা 
  • দেহকান্ড
  • লেজ

রুই মাছের মাথা চারটি অঙ্গ নিয়ে গঠিত। যেমন: 

  • মুখ
  • চোখ
  • নাসারন্ধ্র
  • কানকো 

মাথার বৈশিষ্ট্য:

  • দেহের অগ্রভাগ থেকে কানকোর পশ্চাত প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত
  • ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা; অর্ধচন্দ্রাকার
  • পৃষ্ঠভাগ উত্তল
  • তুণ্ড ভোঁতা 
  • মোটা ঝালরের মত ওষ্ঠ 
  • ম্যক্সিলারি বার্বেল থাকে( ঊর্ধ্ব চোয়ালে) 
  • একজোড়া নাসারন্ধ্র থাকে
  • চোখের পাতা নেই; কর্নিয়া আবৃত
  • মাথা আইশ বিহীন
  • কানকোর নিচে ব্রাঙ্কিওস্টেগাল পর্দা থাকে 

রুই মাছের দেহকান্ডের বৈশিষ্ট্যঃ

  • কানকোর শেষভাগ থেকে পায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত
  • চওড়া অংশ
  • ৫ ধরনের পাখনা বহন করে
  • তিনটি ছিদ্র বিশিষ্ট-
  1. পায়ু ছিদ্র
  2. জনন ছিদ্র
  3. রেচন ছিদ্র

** জনন এবং রেচন ছিদ্র কে একত্রে রেচন-জনন ছিদ্র বলা হয়ে থাকে।

পাখনা ৫ ধরনের

বক্ষ পাখনা: একজোড়া; কানকোর পিছনে দেহকান্ডের সম্মুখ পার্শ্বদিকে অবস্থিত; ১৭-১৮ টি পাখনা রশ্মি আছে

 শ্রোণি পাখনা: একজোড়া; বক্ষ পাখনার পিছনে অবস্থিত; ৯ টি পাখনা রশ্মি যুক্ত 

পায়ু পাখনা: একটি; পায়ুর ঠিক পিছনে দেহের অঙ্কদেশের মাঝখান বরাবর অবস্থিত; ৬-৭ টি পাখনা রশ্মি যুক্ত 

পুচ্ছ পাখনা: লেজের পিছনে অবস্থিত; ১৯ টি পাখনা রশ্মি

পাখনার কাজ:

  • পুচ্ছ পাখনা চলাচলে সাহায্য করে
  • অবশিষ্ট পাখনা ভার 
  • পার্শ্ব রেখাতন্ত্রে অবস্থিত সংবেদী কোষ পানির গুনাগুন সংক্রান্ত রাসায়নিক সংবেদ গ্রহণ করে

পার্শ্ব রেখাতন্ত্র কি? 

দেহের দুই পাশে ছোট ছোট গর্ত সারিবদ্ধ ভাবে আইশের নিচে অবস্থিত একটি লম্বা খাদের সাথে যুক্ত থাকে। এই খাদ ও গর্তের সমন্বয়ে পার্শ্ব রেখাতন্ত্র গঠিত। 

লেজের বৈশিষ্ট্য:

  • পায়ুর পরবর্তী অংশ
  • শীর্ষে থাকে হোমোসার্কাল ধরনের পুচ্ছপাখনা
  • উল্লম্বতলে প্রসারিত
  • ডার্মাল রশ্মি উপরে ও নিচে বড়, মাঝখানে ছোট

মাছের আইশ: 

  • সাইক্লয়েড ধরনের
  • মিউকাস্‌ময় 
  • কেন্দ্র( ফোকাস) লালচে, প্রান্ত কালো রঙের হয়
  • উপরিভাগে উঁচু আল(সারকুলাস) ও নিচু খাদ তৈরি হয় 
  • উন্মুক্ত অংশে বৃদ্ধি রেখা ও রঞ্জক কোষ থাকে 

রুই মাছের রক্তের বৈশিষ্ট্যঃ

  • লাল রঙের
  • রক্তরস এবং রক্তকনিকা থাকে

রক্তকনিকা দুই প্রকার যথাঃ

১। লোহিত রক্তকণিকা 

২। শ্বেত রক্তকণিকা 

লোহিত রক্তকণিকা 

  • ডিম্বাকার 
  • এতে থাকে নিউক্লিয়াস

 শ্বেত রক্তকণিকা 

  • দেখতে অ্যামিবার মত

রক্ত সংবহনতন্ত্র তিনটি তন্ত্র নিয়ে গঠিত। যথাঃ 

  • হৃৎপিণ্ড
  • ধমনিতন্ত্র
  • শিরাতন্ত্র 

রুই মাছের হৃদপিণ্ডের অবস্থান:

  • রুই মাছের ফুলকা দুইটির পেছনে পেরিকারডিয়াল গহ্বর নামে বিশেষ এক গহ্বরে হৃদপিণ্ডের অবস্থান।

হৃদপিণ্ডের গঠন: 

 রুই মাছের হৃদপিণ্ডের দুইটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। যথা: 

  • অ্যাট্রিয়াম 
  • ভেন্ট্রিকল

এর সাইনাস ভেনেসাস নামের একটি উপপ্রকোষ্ঠও রয়েছে। 

সাইনাস ভেনেসাস:

  • পাতলা প্রাচীর বিশিষ্ট
  • হৃদপিণ্ডের পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত
  • সাইনো-অ্যাট্রিয়াল ছিদ্রের মাধ্যমে আট্রিয়ামের সাথে যুক্ত থাকে

অ্যাট্রিয়াম:

  • হৃদপিণ্ডের সবচেয়ে বড় প্রকোষ্ঠ
  • পেরকারডিয়াল গহ্বরের পৃষ্ঠদেশের সামনের দিকে অবস্থান করে
  • একদিকে সাইনাস ভেনেসাস এবং আরেকদিকে অ্যাট্রিও-ভেন্ট্রিকুলার ছিদ্রপথের সাথে যুক্ত থাকে।

ভেন্ট্রিকল:

  • হৃদপিণ্ডের সর্বশেষ প্রকোষ্ঠ 
  • প্রাচীর থাকে বেশ পুরু এবং মাংসল
  • পেরিকার্ডিয়াল  গহ্বরের পিছন দিকে থাকে

বাল্বাস আরটারিওসাস:

  • ভেন্ট্রিকল থেকে ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টার মাঝখানে একটি স্ফীত অংশ 
  • হৃদপিণ্ডের কোন অংশ নয়
  • ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টারই স্ফীত হওয়া গোঁড়া বা মূল 
  • হৃদপিণ্ড থেকে ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টায় রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে

কপাটিকাসমূহ:

  • হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠ ও উপপ্রকোষ্ঠগুলোর সংযোগ ছিদ্রে কপাটিকা থাকে 
  • একমুখী 
  • বিপরীত প্রবাহে বাধা দেয় 

কপাটিকাগুলো তিন ধরনের। যথা: 

  • সাইনো-অ্যাট্রিয়াল কপাটিকা থাকে সাইনাস ভেনেসাস এবং অ্যাট্রিয়ামের মাঝখানের ছিদ্রপথে 
  • অ্যাট্রিও- ভেন্ট্রিকুলার কপাটিকা থাকে অ্যাট্রিয়াম এবং ভেন্ট্রিকলের মাঝে
  • ভেন্ট্রিকুলো-বাল্বাস কপাটিকা থাকে ভেন্ট্রিকল এবং বাল্বাস আরটারিওসাসের মাঝখানে

হৃদপিণ্ডে রক্তের একমুখী গতিপথ:

সাইনাস ভেনেসাস –অ্যাট্রিয়াম- ভেন্ট্রিকল-বাল্বাস আরটারিওসাস-ফুলকা 

***হৃদপিণ্ডের মধ্যে দিয়ে কেবল কার্বনডাইঅক্সাইড যুক্ত রক্ত

প্রবাহিত হয় বলে রুই মাছের হৃদপিণ্ডকে ভেনাস হার্ট বা শিরা হৃদপিণ্ড বলা হয়। 

রুই মাছের ধমনিতন্ত্র প্রধানত দুই ধরনের ধমনী নিয়ে গঠিত 

  • অন্তর্বাহী(ইফারেন্ট) ব্রাঙ্কিয়াল ধমনী
  • বহির্বাহী(অ্যাফারেন্ট) ব্রাঙ্কিয়াল ধমনী

অন্তর্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনী:

বাল্বাস আরটারিওসাস থেকে সৃষ্ট যেসব পার্শ্বীয় রক্তনালি পথে CO2 সমৃদ্ধ রক্ত দুপাশের ফুলকায় বাহিত হয় সেগুলো  অন্তর্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনী।

  • ৪ জোড়া
  • ১ম,২য়,৩য় ও ৪র্থ জোড়া যথাক্রমে ১ম,২য়,৩য় ও ৪র্থ ফুলকায় প্রবেশ করে

বহির্বাহী ব্রঙ্কিয়াল ধমনী:

ফুলকায়  CO2 সমৃদ্ধ রক্ত O2  সমৃদ্ধ হওয়ার পর যে পার্শ্বীয় নালিগুলো দিয়ে ওই রক্ত ডর্সাল অ্যাওর্টায় বাহিত হয় সেগুলো বহির্বাহী ব্রঙ্কিয়াল ধমনী।

বহির্বাহী ব্রঙ্কিয়াল ধমনী:

  • চার জোড়া
  • অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত বহন করে

রুই মাছের শিরাতন্ত্র:

  • একজোড়া সম্মুখ কার্ডিনাল শিরা
  • একজোড়া পশ্চাৎ কার্ডিনাল শিরা 
  • একটি হেপাটিক পোর্টাল 
  • একটি রেনাল পোর্টাল শিরা নিয়ে গঠিত

শ্বসন কৌশল (Mechanism of Respiration)

রুই মাছে দুই ধাপে শ্বাসক্রিয়া ঘটে। এক্ষেত্রে ফুলকা প্রকোষ্ঠ চোষণ পাম্প (suction pump) হিসেবে কাজ করে। 

শ্বাসগ্রহণ বা প্রশ্বাস (Inspiration):

কানকো-দুটি যখন উত্তোলিত হয় তখন ফুলকা প্রকোষ্ঠের মুখ ব্রাঙ্কিওস্টেগাল ঝিল্লি দিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এতে গলবিলে একটি চোষণ-বলের সৃষ্টি হয়। ফলে মুখছিদ্র রক্ষাকারী মৌখিক কপাটিকা খুলে যায় এবং পানি মুখের ভেতর দিয়ে মুখগহ্বরে প্রবেশ করে।

শ্বাসত্যাগ বা নিঃশ্বাস (Expiration): 

কানকো যখন পেশি-সংকোচনের ফলে নেমে আসে তখন গলবিল ও মুখগহবরে চাপ বেড়ে যায়। সাথে সাথেই মৌখিক কপাটিকা মুখছিদ্রকে বন্ধ করে দেয় এবং ফুলকা-প্রকোষ্ঠের ছিদ্র উন্মুক্ত হয়। পানি তখন এ ছিদ্রপথেই বেরিয়ে যায়। মুখ ও গলবিলের ভেতর দিয়ে অতিক্রমের সময় স্রোতপ্রবাহ নিচে অবস্থিত ফুলকাগুলোকে ভিজিয়ে দেয়।

রুই মাছের প্রজনন(Reproduction):

১। দুই বছর বয়সে রুই মাছ জননক্ষম হয়

২। জুন-জুলাই মাসের দিকে প্রজননের জন্য তৈরি হয়

৩।  স্ত্রী মাছ ৫১-৭০ সেমি এবং পুরুষ মাছ ৬৫ সেমি লম্বা হলে প্রজননের জন্য তৈরি হয়

৪। প্রতি কেজি দেহ ওজনের জন্য ১-৪ লক্ষ ডিম উৎপাদন করে থাকে

৫। স্রোতযুক্ত নদীর পানিতে জনন ঘটে, বদ্ধ পানিতে নয় 

রুই মাছের নিষেক:

১। নিষেকের সময় নদীর পানির তাপমাত্রা থাকে ২৭-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস

২। নদীর  পানি এসময় ঘোলা থাকে এবং পানি ফুলে উঠে

৩। পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকে 

৪। দেহের বাইরে নদীর পানিতে নিষেক হয় বলে একে বহিঃনিষেক বলে 

রুই মাছের জীবন ইতিহাস:

  • ডিম নিষিক্ত হওয়ার ৩০-৪৫ মিনিট পর বিভাজন বা ক্লিভেজ শুরু হয়
  • নিষিক্ত ডিম্বাণু মাইটোসিস বিভাজনের মাধ্যমে ছোট ছোট কোষ বা ব্লাস্টোমিয়ার ফর্ম করে
  • ব্লাস্টোডার্ম আর পেরিব্লাস্ট নামে দুইটি স্তর তৈরি করে যাকে  একত্রে বলা হয় ব্লাস্টুল
  • ব্লাস্টুলা থেকে বিভিন অঙ্গ তৈরি হয় যাকে বলে অরগানোজেনেসিস
  • ৫-৬ ঘণ্টা পরে কুসুমের দুই প্রান্ত সরু হয় এবং তখন কুসুম থলি বড় থাকে যা থেকে লার্ভা পুষ্টি গ্রহণ করে 
  • ১২ ঘণ্টা পর লার্ভার চোখের রঙ কালো হতে থাকে ক্রোমাটোফোরের কারণে
  • ২৪ ঘণ্টা পরে ফুলকা আর্চ দৃশ্যমান হয়
  • নটোকর্ড পিছনের দিকে ঊর্ধ্বমুখী হয় 
  • লেজ ও পায়ু-পাখনা স্পষ্ট দেখা যায়
  • ৪৮ ঘণ্টা পর লার্ভা লম্বা হয় 
  • বায়ুথলি দেখা যায়
  • ফুলকা আর্চ স্পষ্ট
  • ৭২ ঘণ্টা পর কুসুম থলি বিলীন হয়ে যায়
  • লার্ভা দশার সমাপ্তি ঘটে 
  • ৯৬ ঘণ্টা পরে লার্ভার মুখ স্পষ্ট হয়ে খাদ্য গ্রহণ শুরু করে
  • কুসুম থলি মিলিয়ে যায়
  • ১৫ দিন বয়সে মুখে বারবেল দেখা যায়
  • পায়ু, খাদ্যনালী স্পষ্ট হয়
  • আইশ দৃশ্যমান হয়না
  • দৈহিক গরন মোটামোটি সম্পূর্ণ হয়
  • এরপর কেবল আঙ্গিক পরিবর্তন এবং আকারের পরিবর্ধন হয় 

রুই মাছ সংরক্ষণ

  • রুই মাছের বিচরণ স্থলগুলোকে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করা 
  • হালদা নদীকে বিশেষ জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা
শেয়ার:

Similar Posts

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 + eight =