পর্যায় সারণি

পর্যায় সারণি

পর্যায় সারণি কি?

পর্যায় সারণি হচ্ছে বিভিন্ন মৌলের মধ্যে ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের মিল বা অমিল এবং সে সকল ধর্মের মধ্যে পরিবর্তন দেখার জন্য যে সকল মৌলের পর্যায় সারণি সাজানো হয়।

অর্থাৎ, যে কোন মৌলের ভৌত এবং রাসায়নিক ধর্মের মধ্যে মিল, অমিল এবং ধর্মের পরিবর্তন তালিকা তৈরি করা হয় তাকে পর্যায় সারণি বলা হয়।

পর্যায় সারণির ইতিহাস

১৭৮৯ সালে রসায়নবিদ ল্যাভয়সিয়ে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৩৩ টি রাসায়নিক উপাদানকে ধাতু ও অধাতু, এই দুইভাগে বিভক্ত করেন। যদিও ল্যাভয়সিয়ের সমসাময়িক রসায়নবিদগণ আরও উন্নত শ্রেণিবিন্যাসকরণ পদ্ধতির সন্ধান করছিলেন।

১৮২৯ সালে জার্মান রসায়নবিদ ডোবেরেইনার প্রমাণ করেন, তিনটি করে মৌল একই ধর্ম প্রদর্শন করে। তিনি প্রথমে পারমাণবিক ভর অনুযায়ী তিনটি করে মৌল সাজিয়ে মৌলের একটি সারণি তৈরি করেন। ডোবেরেইনার আরও প্রমাণ করেন, ২য় মৌলের পারমাণবিক ভর ১ম ও ৩য় মৌলের পারমাণবিক ভরের সমষ্টির সমান বা অর্ধেক। একে ডোবেরেইনারের ত্রয়ীসূত্র বলে।

ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড ১৮৬৪ সালে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৌলগুলোকে তাদের ভর অনুসারে সাজিয়ে মৌলগুলোর প্রতি অষ্টম মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের মধ্যে মিল পান।

পরবর্তীকালে ১৮৬৯ সালে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিফের সকল মৌলের জন্য একটি সাধারণ পর্যায় সূত্র আবিষ্কার করেন, যা হল- “মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম তাদের পারমাণবিক ভর বৃদ্ধির সঙ্গে পর্যায় ক্রমে আবর্তিত হয়”। উক্ত সূত্রানুসারে তিনি ও জার্মান বিজ্ঞানী ইউলিয়ুস লোটার মাইয়ার মিলে আধুনিক পর্যায় সারণি প্রকাশ করেন। তখন ৬৭ টি মৌল নিয়ে পর্যায় সারণি গঠিত হয়েছিল যার মধ্যে ৬৩ টি আবিষ্কৃত হয়েছিলো। ১৯০০ সালের মধ্যে আরও ৩০ টি মৌল পর্যায় সারণিতে যুক্ত হয়। এভাবেই সূচনা হয় আধুনিক পর্যায় সারণির।

প্রথমদিকে পারমাণবিক ভরের উপর নির্ভর করে পর্যায় সারণি সাজানো হয়েছিল। কিন্তু এতে মৌলের ধর্মের শ্রেণিবিন্যাসকরণে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। ১৯১৩ সালে রসায়নবিদ হেনরি মোসলে পারমাণবিক ভরের বদলে পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী মৌলসমূহকে সাজানোর প্রস্তাব দেন। বর্তমানে আধুনিক পর্যায় সারণির জনক তাকে বলা হয়।

পর্যায় সারণির বৈশিষ্ট্য

  • পর্যায় সারণিতে ৭ টি পর্যায় (Period) বা অনুভূমিক সারি এবং ১৮ টি গ্রুপ বা খাড়া স্তম্ভ
  • (প্রতিটি পর্যায় বাম দিকে গ্রুপ ১ থেকে শুরু করে ডানদিকে গ্রুপ ১৮ পর্যন্ত বিস্তৃত।
  • মূল পর্যায় সারণির নিচে আলাদাভাবে ল্যান্থানাইড ও অ্যাক্টিনাইড সারির মৌল হিসেবে দেখানো হলেও এগুলো যথাক্রমে 6 এবং 7 পর্যায়ের অংশ ।
  • পর্যায় ১ এ শুধু ২ টি মৌল রয়েছে ।
  • পর্যায় ২ এবং পর্যায় ৩ এ ৮ টি করে মৌল রয়েছে।
  • পর্যায় ৪ এবং পর্যায় ৫ এ ১৮ টি করে মৌল রয়েছে।
  • পর্যায় ৬ এবং পর্যায় ৭ এ ৩২ টি করে মৌল রয়েছে।
  • গ্রুপ ১ এ ৭ টি মৌল রয়েছে । 
  •  গ্রুপ ২ এ ৬ টি মৌল রয়েছে।
  • গ্রুপ ৩ এ ৩২ টি মৌল রয়েছে।
  • গ্রুপ ৪ থেকে গ্রুপ ১২ পর্যন্ত প্রত্যেকটি গ্রুপে ৪ টি করে মৌল রয়েছে।
  • গ্রুপ ১৩ থেকে গ্রুপ ১৭ পর্যন্ত প্রত্যেকটিতে ৬ টি করে মৌল রয়েছে।
  • গ্রুপ ১৮ এ ৭ টি মৌল রয়েছে।

বি.দ্র.  যে সকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৫৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত এরকম ১৫ টি মৌলকে ল্যান্থানাইড সারির মৌল বলা হয়।

যে সকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৮৯ থেকে ১০৩ পর্যন্ত এরকম ১৫ টি মৌলকে অ্যাক্টিনাইড সারির মৌল বলা হয়।  ল্যান্থানাইড সারির মৌলগুলোর ধর্ম এবং অ্যাক্টিনাইড সারির মৌলসমূহের ধর্ম এত কাছাকাছি যে তাদেরকে পর্যায় সারণির নিচে ল্যান্থানাইড সারির মৌল এবং অ্যাক্টিনাইড সারির মৌল হিসেবে আলাদাভাবে রাখা হয়েছে।

পর্যায় সারণির কিছু ব্যতিক্রম

হাইড্রোজেনের অবস্থান: 

হাইড্রোজেন একটি অধাতু। কিন্তু পর্যায় সারণিতে হাইড্রোজেনকে তীব্র তড়িৎ ধনাত্মক ক্ষার ধাতু Na, K, Rb, Cs, Fr এর সাথে গ্রুপ-1 এ স্থান দেওয়া হয়েছে। এর কারণ ক্ষার ধাতুর মতো হাইড্রোজেন (H) এর বাইরের প্রধান শক্তিস্তরে একটিমাত্র ইলেকট্রন রয়েছে। আবার, হাইড্রোজেনের অনেক ধর্ম ক্ষার ধাতুগুলোর ধর্মের সাথে মিলে যায়। অন্যদিকে, হ্যালোজেন মৌল (F, cl, Br,I)  এর একটি পরমাণু যেমন একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারে, হাইড্রোজেনও তেমনি একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারে অর্থাৎ হাইড্রোজেন (H)  এর অনেক ধর্ম হ্যালোজেন মৌলের ধর্মের সাথে মিলে যায়। তবে হাইড্রোজেনের বেশির ভাগ ধর্ম ক্ষার ধাতুসমূহের ধর্মের সাথে মিলে যাওয়ায় একে ক্ষার ধাতুর সাথে গ্রুপ 1 এ স্থান দেওয়া হয়েছে। 

হিলিয়ামের অবস্থান: 

হিলিয়ামের ইলেকট্রন বিন্যাস He (2)-1s2। হিলিয়ামের ইলেকট্রন বিন্যাস অনুসারে একে গ্রুপ-2 এ স্থান দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু গ্রুপ-2 এর মৌলসমূহ তীব্র তড়িৎ ধনাত্মক। এদের মৃৎক্ষার ধাতু বলে। অপরদিকে He একটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস। এর ধর্ম অন্যান্য নিষ্ক্রিয় গ্যাস নিয়ন,আর্গন, ক্রিপ্টন, জেনন, রেডন ইত্যাদির সাথে মিলে যায়। হিলিয়াম (He) এর ধর্ম কখনই তীব্র তড়িৎ ধনাত্মক মৃৎক্ষার ধাতুর মতো হয় না। তাই হিলিয়ামকে নিষ্ক্রিয় গ্যাসসমূহের সাথে গ্রুপ-18 তে স্থান দেওয়া হয়েছে। 

ল্যান্থানাইড সারির এবং অ্যাকটিনাইড সারির মৌলগুলোর অবস্থান: 

পর্যায় সারণিতে ল্যান্থানাইড সারির মৌলগুলো 6 নম্বর পর্যায় ও 3 নম্বর গ্রুপে অবস্থিত এবং অ্যাকটিনাইড সারির মৌলগুলো 7 নম্বর পর্যায় ও 3 নম্বর গ্রুপে অবস্থিত। এই অবস্থানগুলোতে ল্যান্থানাইড সারির এবং অ্যাকটিনাইড সারির মৌলগুলোকে বসালে পর্যায় সারণির সৌন্দর্য নষ্ট হয়। কাজেই পর্যায় সারণিকে সুন্দরভাবে দেখানোর জন্য ল্যান্থানাইড সারির এবং অ্যাকটিনাইড সারির মৌলগুলোকে পর্যায় সারণির নিচে আলাদাভাবে রাখা হয়েছে।

শেয়ার:

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 + fourteen =