বাগযন্ত্র

বাগযন্ত্র

থ্রি ইডিয়টস – বিখ্যাত এই সিনেমা দেখেনি এমন মানুষ মনে হয় কমই আছে। তবে আজকে আমরা এই সিনেমার কোন মুভি রিভিউ করছিনা, আমরা এই সিনেমার একটি দৃশ্য নিয়ে কথা বলব। 

সিনেমার একটি দৃশ্যে শিক্ষক র‍্যাঞ্চোকে (আমির খান) মেশিনের সংজ্ঞা জিজ্ঞাসা করলে সে বইয়ের সংজ্ঞা না বলে নিজের মতো করে একটা সংজ্ঞা বলে। তার সেই সহজ ভাষার সংজ্ঞাটি অবশ্য শিক্ষকের পছন্দ হয় না, তিনি চাচ্ছিলেন গৎবাঁধা সংজ্ঞা যা পরীক্ষার খাতায় লেখা হবে। কিন্তু একটা বিষয় বোঝার জন্য যদি সহজ ভাষায় সেটা ব্যাখ্যা করা হয়, সেটাই তো সুবিধাজনক তাইনা? 

আজকে আমরাও মেশিন বা যন্ত্র নিয়ে আলোচনা করবো। যন্ত্র শুনে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই, এই যন্ত্র জটিল খটোমটো কোন যন্ত্র নয়। এটি বাগযন্ত্র। আজকে আমরা এই যন্ত্রটি নিয়ে সিনেমার র‍্যাঞ্চোর মতো সহজ ভাষায় বোঝার চেষ্টা করব।

চলো,তাহলে প্রথমেই বাগযন্ত্র দেখে নেওয়া যাক।

ছবিটি দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যখন বাগ্‌যন্ত্রের প্রতিটি অংশ ব্যাখ্যা করা হবে, তখন দেখবে এটি মোটেই কঠিন কিছু নয়।

বাগযন্ত্র নিয়ে জানার শুরুতেই আমরা ‘বাগযন্ত্র’ শব্দটির দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করি। বাগযন্ত্র শব্দটি তৈরি হয়েছে বাক্ এবং যন্ত্র শব্দ দুটির সাহায্যে। আমরা জানি, বাক্ শব্দের অর্থ হলো  বাক্য, শব্দ বা কথা এবং যন্ত্র শব্দের অর্থ হলো যা কোনো কিছু তৈরি করে। বাগযন্ত্র শব্দের অর্থের দিক বিবেচনা করে আমরা বলতে পারি, বাগযন্ত্র হলো মানব দেহের কতগুলো অঙ্গের সমষ্টি যা ধ্বনি উচ্চারণ করতে সাহায্য করে। মূলত মানুষের শরীরের ফুসফুস থেকে ঠোঁট পর্যন্ত ধ্বনি উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতিটি অঙ্গ ধ্বনি উচ্চারণে ব্যবহ্রত হয়। অর্থাৎ এগুলোই বাগ্‌যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ। 

বাগ্‌যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ বা প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে জানার আগে চলো একটু জেনে নেই প্রত্যঙ্গ বিষয়টি কী তা সম্পর্কে। প্রত্যঙ্গ শব্দের অর্থ হলো উপ-অঙ্গ। মূল অঙ্গের বিভিন্ন অংশকে বলা হয় প্রত্যঙ্গ। যেমন: হাত হলো মানুষের শরীরের প্রধান একটি অঙ্গ আর এই প্রধান অঙ্গের প্রত্যঙ্গ হলো আঙুল। আমাদের প্রতি হাতে পাঁচটি আঙুল থাকে। অর্থাৎ, অঙ্গের অনেকগুলো প্রত্যঙ্গ থাকতে পারে। আশা করি প্রত্যঙ্গ কী তা বুঝতে পেরেছ।

এমনিভাবেই বাগযন্ত্র হলো মানব দেহের অন্যতম প্রধান একটি অঙ্গ যার রয়েছে একাধিক প্রত্যঙ্গ। ফুসফুস, স্বরযন্ত্র, জিভ, দাঁত, ঠোঁট, তালু, আলজিভ, মুখগহ্বর ইত্যাদি প্রত্যঙ্গ নিয়ে বাগযন্ত্র গঠিত হয়।

বাগ্‌যন্ত্রের প্রধান প্রত্যঙ্গটি হলো ফুসফুস। আমরা সবাই ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস গ্রহণ করি ও ত্যাগ করি। কিন্তু একটি মজার বিষয় কি জানো?  ফুসফুসের সাহায্যে যখন আমরা শ্বাস ত্যাগ করি তখন সেই ত্যাগ করা বায়ুর সাহায্যেই আমরা বিভিন্ন ধ্বনি তৈরি করি আর এই ধ্বনি দিয়েই পরে তৈরি হয় শব্দ, শব্দ দিয়েই তৈরি হয় বাক্য আর এই বাক্যের সমন্বয়ে তৈরি হয় ভাষা। সুতরাং বুঝতেই পারছো ফুসফুসই হলো ভাষা সৃষ্টির মূল বিষয়। অন্যভাবে বলা যায় ফুসফুস হলো ধ্বনি সৃষ্টিকারী বায়ুপ্রবাহের প্রধান উৎস।

বাগ্‌যন্ত্রের পরবর্তী প্রত্যঙ্গটি হলো শ্বাসনালি। শ্বাসনালি হলো বাগ্‌যন্ত্রের সাথে যুক্ত একটি প্রত্যঙ্গ যার মধ্য দিয়ে ফুসফুস থেকে আসা বাতাস আমাদের নাকের গর্ত দিয়ে বের হয়। শ্বাসনালি সরাসরি ধ্বনি তৈরিতে সাহায্য করে না, তবে যে বায়ুর সাহায্যে ধ্বনি তৈরি হয় সেই বায়ু চলাচলে সাহায্য করে।

এখন আমরা জানব স্বরযন্ত্র সম্পর্কে। শ্বাসনালির উপরেই এর অবস্থান।  এটি মূলত মেরুদণ্ডের ৪, ৫ ও ৬ নং হাড়ের পাশে থাকা একটি নলের মতো অংশ। শ্বাসনালি থেকে যে বাতাস আসে তা স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়ই ধ্বনি উচ্চারিত হয়। আসলে ধ্বনি তৈরির মূল কারিগরই হলো আমাদের এই স্বরযন্ত্র। স্বরযন্ত্রের মধ্যে দুটি পর্দার মতো অংশ আছে। এই অংশ দুটি বাতাসের ধাক্কায় কেঁপে উঠে, ধ্বনি তৈরি করা স্বরযন্ত্রের এই অংশটিকে বলা হয় স্বররন্ধ্র। স্বররন্ধ্র ছাড়াও স্বরযন্ত্রের আরও দুটি অংশ আছে যার একটির নাম অধিজিহ্বা ও অপরটির নাম ধ্বনিদ্বার।

বাগ্‌যন্ত্রের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গটি হলো জিহ্বা বা জিভ। জিহ্বা তো আমরা সবাই চিনি। আমাদের মুখের ভিতরের নিচের অংশে এর অবস্থান। জিহ্বা সম্পর্কে বলার আগে তোমাদের একটি মজার বিষয় জানিয়ে রাখি, বাগ্‌যন্ত্রের সবগুলো প্রত্যঙ্গের মধ্যে এটিই সবচেয়ে সচল ও সক্রিয় অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি নড়াচড়া করে এবং অন্যান্য প্রত্যঙ্গকে স্পর্শ করে। আর জিহ্বার নড়াচড়া অর্থাৎ ওঠা, নামা, সামনে বা পিছনে যাওয়া ও অন্য প্রত্যঙ্গকে স্পর্শ করার মাধ্যমে বিভিন্ন রকম ধ্বনি তৈরি হয় এবং বৈচিত্র্যময় ধ্বনি তৈরি হয়।

এবার চলো জেনে নেই আলজিভ সম্পর্কে। এটিও মুখের মধ্যে অবস্থিত একটি প্রত্যঙ্গ। তুমি যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বড়ো করে আ করো তাহলে মুখের শেষ অংশে একটি ঝুলন্ত মাংসপিণ্ড দেখতে পাবে। ঐ ঝুলন্ত মাংসপিণ্ডই আলজিভ। এটি মুখের উপরের কোমল তালুর সাথে যুক্ত থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। আলজিভ উপরে এবং নিচে নড়াচড়া করতে পারে। একটি মজার বিষয় হলো কোমল তালুর সাথে আলজিভ যখন নিচে নামে তখন ফুসফুস থেকে আসা বাতাস মুখের পাশাপাশি নাক দিয়েও বের হয় এবং এর ফলে আমরা নাসিক্য ধ্বনি অর্থাৎ ঙ, ন, ম এগুলো উচ্চারণ করতে পারি।

আমাদের পরবর্তী প্রত্যঙ্গটি হলো তালু। তালু আমাদের মুখের ভিতরের উপরের অংশে অবস্থিত। একে মুখের ভিতরের অংশের ছাদ বলা যেতে পারে। তালুকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়, যথা – শক্ত তালু ও কোমল তালু। দাঁতের গোড়া থেকে কোমল তালুর আগ পর্যন্ত অংশ হলো শক্ত তালু। শক্ততালুর পর থেকে আলজিভ পর্যন্ত অংশ হলো কোমল তালু। জিভ তালুকে স্পর্শ করে বিভিন্ন ধ্বনি উচ্চারণ করে। চ, ছ, জ, ঝ, শ ইত্যাদি তালব্য ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো শক্ত তালুর সাহায্যে উচ্চারিত হয়। অন্য দিকে জিভ কোমল তালুকে স্পর্শ করে ক, খ, গ, ঘ ইত্যাদি কণ্ঠ্যধ্বনি তৈরি করে।

এরপর যে প্রত্যঙ্গটি সম্পর্কে আমরা জানব সেটি হলো মূর্ধা। মুখের ভিতরে, উপরের পাটির দাঁতের পেছনে একটি শক্ত উঁচু অংশ থাকে যেটি মূর্ধা নামে পরিচিত। এটি শক্ত তালুর আগে এবং উপরের পাটির দাঁতের গোড়ার মাঝে অবস্থিত। জিভের ডগা এই মূর্ধাকে স্পর্শ করে ট, ঠ, ড, ঢ ইত্যাদি মূর্ধন্য ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো তৈরি করে।

এখন আমরা বাগ্‌যন্ত্রের যে প্রত্যঙ্গটি সম্পর্কে জানবো সেটি হলো দন্ত ও দন্তমূল। দাঁতের গোড়ার অংশই হলো দন্তমূল। ধ্বনি তৈরিতে উপরের পাটির দাঁতের মূল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিভ উপরের পাটির, দাঁতের মূলের সাথে স্পর্শ করে ন, র, ল, স ইত্যাদি দন্তমূলীয় ধ্বনি তৈরি করে।

আমাদের প্রত্যেকের দুই পাটি দাঁত থাকে। তবে ধ্বনি উৎপাদনে নিচের পাটি দাঁতের তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। জিভ উপরের পাটির দাঁতকে স্পর্শ করে ফুসফুস থেকে আসা বাতাসকে আটকে দিয়ে দন্ত্যধ্বনি অর্থাৎ ত, থ, দ, ধ ইত্যাদি দন্ত ব্যঞ্জনধ্বনি তৈরি করে।  

আজকের আলোচনার আমাদের শেষ প্রত্যঙ্গটি হলো ওষ্ঠ্য বা ঠোঁট। স্বর ও ব্যঞ্জন উভয় ধ্বনি তৈরিতে ঠোঁট ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। মুখের সবচেয়ে বাইরের অংশ হলো ঠোঁট। দুই ঠোঁটের মধ্যকার ফাঁকের কম-বেশির কারণে স্বরধ্বনি সংবৃত বা গোলাকার ও বিবৃত বা অগোলাকার হয়। এ ছাড়া দুই ঠোঁট ফুসফুস থেকে আসা বাতাস আটকে এবং দ্রুত ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে প, ফ, ব, ভ ইত্যাদি ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি তৈরি করে।

এখন নিশ্চয়ই বাগযন্ত্র ও এর বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ কিভাবে কাজ করে তা তোমরা বুঝে গেছো। তবে পরীক্ষার খাতায় কিন্তু বইয়ের ভাষায় গুছিয়ে লিখতে ভুলো না যেন!!

শেয়ার:

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 + 2 =