ঘাসফড়িং

ঘাসফড়িং-এর পরিচিতি

ঘাসে ঘাসে ঘুরে বেড়ায় বলে একে ঘাস ফড়িং নামে ডাকা হলেও, ঘাসফড়িং হলো অর্থোপ্টেরা বর্গের অন্তর্গত সিলিফেরা উপবর্গের কীট। গুল্মের ঝিঁঝিঁ পোকা বা কেটিডিড থেকে পৃথক করার জন্য এদেরকে কখনো কখনো ছোট শিংওয়ালা ঘাসফড়িংও বলা হয়। অন্যদিকে  যেসব প্রজাতি জনঘনত্বের উপর নির্ভর করে রং ও ব্যবহার বদলে ফেলে তাদের বলা হয় পঙ্গপাল।এদের অধিকাংশের রঙ বাদামি এবং এরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও এদের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে মুহুর্তের মধ্যে একটি ক্ষেতের সমস্ত ফসল খেয়ে সাবাড় করে ফেলতে পারে। পঙ্গপাল গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশের শস্যক্ষেতের জন্য মারাত্মক হুমকি। 

ঘাসফড়িংকে কেন ইনসেক্টা শ্রেণির পতঙ্গ বলা হয়। ইনসেক্টা শ্রেণীর পতঙ্গ বলার প্রধান কারন হলো এর দেহের গঠন। দেহ কাইটিনময় বহিঃকঙ্কালে আবৃত। মস্তক, বক্ষ ও উদর-এ বিভক্ত, অর্থাৎ দেহ তিনখণ্ডবিশিষ্ট। এদের তিনজোড়া সন্ধিযুক্ত পা, জটিল পুঞ্জাক্ষি এবং একজোড়া অ্যান্টেনা আছে। ট্রাকিয়া নামক বায়ু নালিকার মাধ্যমে শ্বাস প্রশ্বাস এর কাজ সম্পন্ন করে। মুক্ত রক্ত সংবহনতন্ত্র এবং ম্যালপিজিয়ান নালিকার সাহায্যে রেচন ক্রিয়া সম্পন্ন করে, এসব কারনের জন্য এদের ইনসেক্টা শ্রেণিভুক্ত সদস্য বা পতঙ্গ বলে। এদের দেহের বর্ণ হরিদ্রাভাব সবুজ বা বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে দেহে বিভিন্ন বর্ণের গাঢ় দাগ থাকে। এদের অনেক প্রজাতির দেহের বর্ণ বাসস্থানের সাথে মিলে যায়, যা ক্যামোফ্লাজ নামে পরিচিত।

ঘাসফড়িং-এর শ্রেণিবিন্যাস

Phylum: Arthropoda

      Class: Insecta

            Subclass: Pterygota

                 Order: Orthoptera

                       Family: Acrididae

                              Genus: Poekilocerus

                                    Species: Poekilocerus pictus

ঘাস ফড়িং-এর প্রজাতির সংখ্যা 

সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় বিশ হাজার ও বাংলাদেশে বিশপ্রজাতির ঘাসফড়িং শনাক্ত করা হয়েছে ৷ বাংলাদেশে যে বিশ প্রজাতির ঘাসফড়িং পাওয়া যায়, তার মধ্যে এই চার প্রজাতির ঘাসফড়িং উল্লেখযোগ্য- আর্কিডে এক্সাল্‌টাডা, ফ্লেইওবা ইনফুমেটা, কোরোইডোকাস্‌ রোবাস্‌টস্‌, জেনোকীট্যান্‌টপ্‌স হিউমিলিস্‌। 

ঘাস ফড়িং-এর বসবাস

প্রায় সব ধরনের বসতিতেই বিভিন্ন প্রজাতির ঘাসফড়িং দেখা যায়,তবে ঘাস ফড়িং যেহেতু ঘাস বা লতা পাতা পছন্দ করে তাই নিচু জায়গাতেই এরা বেশ সাচ্ছন্দ্যে থাকে। তবে জলাভূমিরতে এদের বাস করতে দেখা যায় না। যেসব জায়গায় পানি কম উঠানামা করে সেসব জায়গায় এরা ডিম পাড়ে। স্বাদুপানির ও ম্যানগ্রোভ জলাশয়ে যেহেতু পানির উঠানামা বেশি হয় এবং ডিম পাড়ায় জায়গা প্লাবিত হয়ে যায় সে কারণে এসব বসতিতে ঘাসফড়িং কম বাস করে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় এরা বিপুল সংখ্যায় পরিযায়ী হয়, দিনে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।

ঘাসফড়িং-এর খাবার 

ঘাসফ‌ড়িং তৃণ‌ভোজী প্রাণী। ডিম থে‌কে ফোটার পরপরই, নিম্ফ অবস্থায় ঘাসফ‌ড়িং চারপা‌শের যে কোন ছোট ছোট, সহজপাচ্য গাছ, ঘাস বা নতুন কোমল শাখা-প্রশাখা খে‌তে শুরু ক‌রে। দু’একবার খোলস মোচ‌নের পর একটু বড় হ‌লে শক্ত উ‌দ্ভিজ খাবার গ্রহণ ক‌রে। তরুণ ঘাস ফ‌ড়িং পূর্ণাঙ্গ‌দের মতই নি‌র্দিষ্ট উ‌দ্ভিজ খাবার গ্রহণ ক‌রে। 

তখন খাদ্য তা‌লিকায় ঘাস,পাতা ও শস্য প্রধান খাবার হিসে‌বে উ‌ঠে আ‌সে । বে‌শির ভাগ ঘাসফ‌ড়িং উ‌দ্ভিদ থে‌কে আহার সংগ্রহ ক‌রে, দু’একটি প্রজা‌তি সু‌নি‌র্দিষ্ট উ‌দ্ভিদ থে‌কে আহার গ্রহণ ক‌রে।  

ঘাসফড়িং-এর বাহ্যিক গঠন

ঘাসফড়িং-এর দেহ সরু, লম্বাটে, বেলনাকার, খণ্ডায়িত এবং দ্বিপার্শীয় প্রতিসম। এরা তুলনামূলক বৃহদাকৃতির পতঙ্গ এবং লম্বায় ৮-৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। দেহের রঙ অনেকটা হলদে-সবুজ(Yellowish green) ধরনের অথবা বাদামী রঙের মাঝে নানা ধরনের ফোঁটা(spots) বা ডোরাকাটা(markings) হতে পারে। এদের দেহের বর্ণ হরিদ্রাভাব সবুজ বা বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। এদের অনেক প্রজাতির দেহের বর্ণ বাসস্থানের সাথে মিলে যায়, যা ক্যামোফ্লাজ নামে পরিচিত। এটা তাদেরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে ও পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সহায়তা করে ৷ এছাড়াও কিছু ঘাসফড়িং আছে উজ্জ্বল নীল-হলুদ রঙের(যেমনঃ- Poekilocerus pictus)।

ঘাসফড়িং-এর দেহ কাইটিন নির্মিত কিউটিকল নামক বহিঃকঙ্কালে আবৃত। প্রতিটি দেহখণ্ডকে কিউটিকল পুরু ও শক্ত পাতের মতো গঠন সৃষ্টি করে। এদের স্ক্লেরাইট বলে। দুটি স্ক্লেরাইটের মধ্যবর্তী কিউটিকল পাতলা ও নরম থাকে। এদের সূচার বলে। প্রতি দেহখণ্ডকের পৃষ্ঠদেশীয় পাতকে টার্গাম বা টার্গাইট বলে এবং অঙ্কদেশীয় পাতকে স্টার্নাম বা স্টার্নাইট বলে। এরা পার্শ্বদেশে প্লিউরন বা প্লুরাইট পাত দ্বারা পরস্পর যুক্ত থাকে।

অন্যান্য পতঙ্গের মতো ঘাসফড়িং-এর দেহ তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত, যথা

মস্তক:

পুঞ্জাক্ষি,সরলাক্ষি,এন্টেনা,মুখোপাঙ্গো

বক্ষ:

ডানা,পা,স্পাইরাকাল

উদর:

টিমপেনাম,শ্বাসরন্ধ্র,পায়ু,বহিঃজননাঙ্গ

ঘাসফড়িং-এর পরিপাক (Digestion): 

ঘাসফড়িং এর পৌষ্টিকতন্ত্র এর খাদ্যাভ্যাসের সাথে অভিযোজিত এবং এর পরিপাকতন্ত্র ১. পরিপাকনালি (alimentary canal) ও ২. পরিপাকগ্রন্থি (digestive gland) নিয়ে গঠিত। পরিপাকনালি (Alimentary Canal): ঘাসফড়িং এর পরিপাকনালি সরল প্রকৃতির এবং দেহের মধ্যরেখা বরাবর মুখছিদ্র থেকে পায়ুছিদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। পরিপাকনালি ক. স্টোমোডিয়াম, খ. মেসেন্টেরন ও গ. প্রোক্টোডিয়াম এ তিনটি অংশে বিভক্ত।  

স্টোমোডিয়াম বা অগ্রপারিপাকনালি (Stomodaeum or Foregut): 

এটি পরিপাকনালির প্রথম অংশ এবং এটি মুখছিদ্র থেকে গিজার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। স্টোমোডিয়ামের অন্তঃপ্রাচীর কাইটিন নামক শক্ত আবরণে আবৃত। মুখছিদ্রটি ক্ষুদ্র এবং মুখবিবরে উন্মুক্ত। মুখছিদ্রের অঙ্কীয়তলে ফ্যারিংস থাকে। মুখবিবরের পরবর্তী অংশটি হলো গলবিলীয় অন্ননালি যা মোচাকার থলির আকৃতির ক্রপে প্রবেশ করে। ক্রপের পরবর্তী ত্রিকোণাকার বেশ শক্ত, পুরু প্রাচীর বিশিষ্ট অংশটির নাম গিজার্ড। গিজার্ডের অন্তঃপ্রাচীর কাইটিনময় দুটি দাঁত ও পুরু বৃত্তাকার পেশিযুক্ত। গিজার্ডের দৃঢ় সংকোচন প্রসারণে শক্ত খাদ্য চূর্ণ বিচূর্ণ হয়। 

মেসেন্টেরন বা মধ্য পরিপাকনালি বা পাকস্থলি (Mesenteron or midgut): 

মেসেন্টেরন গিজার্ডের পর থেকে শুরু করে পাকস্থলি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। মেসেন্টেরনের অন্তঃপ্রাচীর কিউটিকলের পরিবর্তে পেরিট্রফিক পর্দা দিয়ে আবৃত। মেসেন্টেরন ও স্টোমোডিয়ামের সংযোগস্থলে ছয় জোড়া ফাঁপা, লম্বা, মোচাকৃতির থলি থাকে যা হেপাটিক সিকা বা গ্যাস্ট্রিক সিকা নামে পরিচিত। হেপাটিক সিকা খাদ্যের সার অংশ শোষণে ও উৎসেচক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেসেন্টেরনের শেষ ভাগে সূক্ষ্ম চুলের মত অসংখ্য সবুজ বর্ণের হলদে অঙ্গাণু থাকে। এদেরকে মালপিজিয়ান নালিকা বলে। এরা সাধারণত রেচন অঙ্গ হিসেবে কাজ করে। 

প্রোক্টোডিয়াম বা পশ্চাৎ পরিপাকনালি (Proctodaeum or hindgut): 

প্রোক্টেডিয়াম মালপিজিয়ান নালিকার পশ্চাৎ প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে পায়ুছিদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। এ নালির প্রথম অংশ হলো প্যাচবিহীন প্রশস্ত নলাকার ইলিয়াম পরবর্তী সরু নলাকৃতির অংশের নাম কোলন। কোলনের পরবর্তী সর্বশেষ স্ফীত ও পুরু প্রাচীরযুক্ত থলির ন্যায় অংশের নাম রেকটাম বা মলাশয় যা পায়ুছিদ্রের মাধ্যমে বাইরে উন্মুক্ত হয়।  

ঘাসফড়িং এর পরিপাকগ্রন্থি (Digestive gland): 

ঘাসফড়িং এর দেহে পরিপাকগ্রন্থি হিসেবে লালাগ্রন্থি, মেসেন্টেরনের অšঃÍ আবরণ এবং হেপাটিক সিকা কাজ করে। লালাগ্রন্থি ঘাসফড়িং এর প্রধান পরিপাকগ্রন্থি। স্টোমোডিয়ামের ক্রপের নিচে ক্ষুদ্র, শাখা প্রশাখাযুক্ত একজোড়া লালাগ্রন্থি অবস্থিত। লালাগ্রন্থির নালি ল্যাবিয়ামের গোড়ায় মুখবিবরে উন্মুক্ত হয়। লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারস খাদ্য চর্বণে ও গলাধঃকরণে সহায়তা করে। মেসেন্টেরনের অন্তঃপ্রাচীরে অসংখ্য নিঃ¯্রাবী কোষ থাকে যা থেকে নিঃসৃত পাচকরস খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে। স্টোমোডিয়াম ও মেসেন্টেরনের সংযোগস্থলে হেপাটিক সিকা থাকে যা পরিপাক সহায়ক গ্রন্থি হিসেবে কাজ করে। 

ঘাসফড়িং এর পরিপাকতন্ত্র খাদ্যবস্তু পরিপাক (Digestion of Food): 

খাদ্যবস্তু মুখছিদ্রপথে মুখবিবরে প্রবেশের পর ম্যাক্সিলা ও ম্যান্ডিবল কর্তৃক খাদ্যবস্তু কর্তিত ও প্রেষিত হয়। কর্তিত ও প্রেষিত খাদ্যবস্তুর সাথে লালাগ্রন্থি নিঃসৃত লালারস মিশ্রিত হয়। লালারসে অ্যামাইলেজ, সেলুলেজ প্রভৃতি এনজাইম থাকে যা খাদ্যবস্তুকে পিচ্ছিল করে এবং বিভিন্ন ধরনের শর্করাকে আর্দ্র বিশ্লেষণ করে। ক্রপ থেকে খাদ্যবস্তু গিজার্ডে প্রবেশের পর কাইটিনময় দাঁতে পিষ্ট হয়ে ক্ষুদ্রতর কণায় পরিণত হয়। গিজার্ড থেকে খাদ্যবস্তু পাকস্থলীতে পৌঁছাবার পর পরিপাক ক্রিয়া শুরু হয়। মেসেন্টেরন ও হেপাটিক সিকা নিঃসৃত উৎসেচক বা এনজাইমসমূহ যেমন- মলটেজ, অ্যামাইলেজ, লাইপেজ, প্রোটিয়েজ, ইনভারটেজ, ট্রিপটেজ কঠিন খাদ্যবস্তুকে সরল ও তরল খাদ্যরসে পরিণত করে। পরিপাককৃত তরল খাদ্য সারাংশ মেসেন্টেরনের কোষীয় প্রাচীরের মাধ্যমে পরিশোষিত হয়ে হিমোসিলের মাধ্যমে সারাদেহে পরিবাহিত হয়। খাদ্যে অপাচ্য অংশ যেমন- অ্যামিনো এসিড, ইউরিক এসিড কোলন হয়ে মলাশয়ে মল আকারে প্রবেশ করে। অজীর্ণ খাদ্যবস্তু কোলনের মধ্য দিয়ে মলাশয়ে প্রবেশের পূর্বেই কোলনের প্রাচীর অপাচ্য অংশ থেকে অতিরিক্ত পানি, খনিজ লবণ ইত্যাদি শোষণ করে নেয়। পরে কঠিন অপাচ্য বস্তু মলরূপে পায়ু ছিত্রপথে দেহের বাইরে নির্গত হয়।

ঘাসফড়িং-এর রক্ত সংবহনতন্ত্র (The Circulatory System)

যে তন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত দেহের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয়ে বিভিন্ন পদার্থ পরিবহন করে, তাকে রক্ত সংবহনতন্ত্র বলে। ঘাসফড়িং এর রক্ত সংবহনতন্ত্র মুক্ত ধরনের। কারণ ঘাসফড়িং এর রক্ত নির্দিষ্ট রক্তনালীতে সীমাবদ্ধ না থেকে হিমােসিলের মাধ্যমে মন্থর গতিতে সরাসরি বিভিন্ন কোষের মধ্যে প্রবাহিত হয়। এ সংবহনতন্ত্রকে মুক্ত সংবহনতন্ত্র (Open circulation) বলে। ঘাসফড়িংয়ের রক্ত সংবহনতন্ত্র কয়েকটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত। যথা- রক্ত বা হিমোলিম্ফ, হিমোসিল, হৃৎপিণ্ড, অ্যালারিপেশি ও আনুষঙ্গিক স্পন্দনশীল অঙ্গ। 

হিমোসিল (Haemocoel) 

রক্তপূর্ণ দেহ গগহ্বর কে হিমোসিল বলে।ভ্রূণ অবস্থায় সিলোম ফেটে গিয়ে হিমোসিলের উদ্ভব ঘটে। ঘাসফড়িং এর দেহ গম্বর হিমোসিল (Haemocol) ধরনের। এই দেহ গহ্বর একধরনের অপ্রকৃত দেহ গহ্বর। কারণ, এই গহ্বরের দুইপাশে মেসােডার্ম উদ্ভূত পেরিটোনিয়াল আবরণী নাই। এই গহ্বর রক্ত দ্বারা পূর্ণ থাকে এবং চর্বিকোষ, পরিপাক তন্ত্র, রেচনতন্ত্র , শ্বসনতন্ত্র , প্রজননতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্রকে ধারণ করে। এই সকল তন্ত্রের অঙ্গসমূহ সরাসরি রক্তের মধ্যে অবস্থান করে এবং রক্ত দ্বারা ভিজে থাকে। ঘাসফড়িং এর রক্ত সাদা। একে হিমোলিম্ফ বলে। এই হিমোলিম্ফ বা সাদা রক্ত একবার হৃদযন্ত্রের মধ্যে দিয়ে এবং পরবর্তীতে হিমােসিলের মধ্যে দিয়ে উনমুক্ত অবস্থায় প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ হিমােসিল রক্ত সংবহনতন্ত্রের (মেরুদণ্ডীদের শিরার মত) অংশ হিসাবে কাজ করে।

পৃষ্ঠীয় পর্দা এবং অঙ্কীয় পর্দা নামক দুটি অনুপ্রস্থ পর্দা দ্বারা হিমোসিল  তিনটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। হৃৎপিণ্ডের তলদেশ বরাবর পর্দাকে পৃষ্ঠীয় পর্দা এবং স্নায়ুরজ্জর উপরে অবস্থিত পর্দাকে অঙ্কীয় পর্দা বলে ।

(ক) পেরিকার্ডিয়াল সাইনাস (Pericardial Sinus): এই গহ্বর বা প্রকোষ্ঠ বা সাইনাস পৃষ্ঠীয় দেহ প্রাচীর ও পৃষ্ঠীয় পর্দার মধ্যস্থলে অবস্থিত। এই সাইনাস (Sinus – ফাকা বা গহ্বর) হৃদযন্ত্রকে ধারণ করে। {Peri: চারদিকে Cardial: হৃদযন্ত্র বিষয়ক ]।

(খ) পেরিভিসেরাল সাইনাস (Perivisceral sinus): এই গহ্বর পৃষ্ঠীয় ডায়াফ্রাম বা পর্দা ও অঙ্কীয় ডায়াফ্রামের মধ্যস্থলে অবস্থিত। এই সাইনাসে পৌষ্টিক নালী অবস্থান করে।

(গ) পেরিনিউরাল সাইনাস (Perineural sinus): এই সাইনাস অঙ্কীয় ডায়াফ্রাম ও অঙ্কীয় দেহ প্রাচীরের মধ্যে অবস্থিত। এই সাইনাস অঙ্কীয় স্নায়ুরজুকে (Ventral nerve cord) ধারণ করে।

সংবহন প্রক্রিয়া (Mechanism of Circulation)

অ্যালারি পেশি, হৃদপিন্ড এবং আনুষঙ্গিক স্পন্দনশীল অঙ্গসমূহের সংকোচন প্রসারণের ফলে ঘাসফড়িংয়ের দেহের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্ত প্রবাহিত হয়। হৃদপিন্ডের প্রকোষ্ঠগুলাে পশ্চাৎ থেকে সম্মুখদিকে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে থাকে। ঘাসফড়িংয়ের হৃদপিন্ডের স্পন্দন প্রতিমিনিটে ১০০ থেকে ১১০ বার ঘটে। ঘাসফড়িংয়ের রক্তসংবহন প্রক্রিয়া নিম্নলিখিতভাবে ঘটে থাকে। 

১। অ্যালারি পেশিগুলোর সংকোচনে রক্ত পেরিকার্ডিয়াল সাইনাস থেকে অষ্টিয়ার মাধ্যমে হৃদপিন্ডে প্রবেশ করে।

২। পরে হৃদপিন্ড পর্যায়ক্রমে পশ্চাৎ দিক থেকে সম্মুখ দিকে সংকুচিত হওয়ায় রক্ত সমুখ দিকে প্রবাহিত হয় এবং অ্যাওর্টার মাধ্যমে মস্তকের সাইনাসে এসে পরে।

৩। অষ্টিয়ায় কপটিকা থাকায় রক্ত হৃদপিন্ড থেকে বাইরে আসতে পারে না এবং হৃদপিন্ডের প্রকোষ্টগুলাের সংযোগস্থলে কপাটিকা থাকায় রক্ত পিছন দিকে আসতে পারে না। 

৪। মস্তক থেকে কিছু রক্ত অ্যান্টিনায় প্রবেশ করে। 

৫। এরপর রক্ত পশ্চাৎমুখী হয়ে পেরিনিউরাল সাইনাসে চলে আসে। পেরিনিউরাল সাইনাস থেকে রক্ত পদ ও ডানায় প্রবেশ করে।

৬। এই রক্ত পরবর্তীতে পশ্চাৎমুখী হয়ে পেরিভিসেরাল সাইনাসে প্রবেশ করে।

৭। এরপর হৃদপিন্ড যখন আবার প্রসারিত হয় তখন পেরিভিসেরাল সাইনাস থেকে রক্ত পেরিকার্ডিয়াল সাইনাসে ফিরে আসে।

৮। পেরিকার্ডিয়াল সাইনাস থেকে অ্যালারি পেশিগুলোর সংকোচনে রক্ত অষ্টিয়ার মাধ্যমে পুনরায় হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করে। এভাবে চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটে।

ঘাসফড়িং-এর শ্বসনতন্ত্র

যে তন্ত্রের মাধ্যমে শ্বসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাকে শ্বসনতন্ত্র বলে। ট্রাকিয়া নামক এক ধরনের শ্বাসনালী ও তাদের শাখা-প্রশাখার সমন্বয়ে ঘাসফড়িং এর শ্বসনতন্ত্র গঠিত। এই তন্ত্রকে তাই ট্রাকিয়ালতন্ত্র বলা হয়। ঘাসফড়িং এর ট্রাকিয়ালতন্ত্র নিম্নলিখিত অংশসমূহ নিয়ে গঠিত।যথাঃ

শ্বাসরন্ধ্র বা স্পাইরাকল (Spiracle)

ঘাস ফড়িং এর দেহের  প্রতিপাশে দশটি করে মােট দশ জোড়া শ্বাসরন্ধ্র বা স্পাইরাকল আছে।প্রথম দুইজোড়া বক্ষে এবং অবশিষ্ট আট জোড়া উদরে অবস্থিত। শ্বাসরন্ধ্রগুলাে বিশেষ ধরনের পেশি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কপাটিকার সাহায্যে বন্ধ ও উন্মুক্ত হয়।

ট্রাকিয়া (Trachea) বা শ্বাসনালি

প্রতিটি শ্বাসরন্ধ্রের অ্যাট্রিয়াম ট্রাকিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। ট্রাকিয়া স্থিতিস্থাপক। ট্রাকিয়ার ভেতরে কাইটিন নির্মিত ইন্টিমা আংটির মতো বলয় গঠন করে। একে টিনিডিয়া (Ctenidia) বলে। টিনিডিয়াম থাকায় ট্রাকিয়ার গহ্বর চুপসে যায় না। দেহে ট্রাকিয়া জালিকার মত বিন্যস্ত থাকলেও এদের মধ্যে প্রধান কতকগুলাে নালি অনুদৈর্ঘ্য ও অনুপ্রস্থভাবে বিন্যস্ত থাকে। এগুলোকে ট্রাকিয়াল কাণ্ড (Trachial trunk) বলে।

মোট ৩ জোড়া অনুদৈর্ঘ্য ট্রাকিয়াল কাণ্ড দেহের দৈঘ্য বরাবর বিন্যস্ত থাকে। যথা- 

(i) দেহের দু’পাশে দুটি পার্শ্বীয় অনুদৈর্ঘ্য ট্রাকিয়াল কাণ্ড।

(ii) মধ্যরেখায় দুটি পৃষ্ঠীয় অনুদৈর্ঘ্য ট্রাকিয়াল কাণ্ড।

(iii) অঙ্কীয় অঞ্চলের স্নায়ু রজ্জুর দুপাশে দুটি অঙ্কীয় অনুদৈর্ঘ্য ট্রাকিয়াল কাণ্ড। 

দেহের প্রতিপাশে অবস্থিত পার্শ্বীয় ট্রাকিয়াল কাণ্ড থেকে পৃষ্ঠীয় ও অঙ্কীয় দিকে কতকগুলাে অনুপ্রস্থ ট্রাকিয়াল কাণ্ড সৃষ্টি হয়। এরা যথাক্রমে পৃষ্ঠীয় ও অঙ্কীয় ট্রাকিয়াল কাণ্ডকে যুক্ত করে। ঘাসফড়িংয়ের শ্বসন তন্ত্রের বিশেষত্ব হলো-এর কতকগুলো ট্রাকিয়া প্রসারিত হয়ে মস্তক, বক্ষ ও উদর অঞ্চলে বড় আকারের বায়ু থলি (air sac) গঠন করে। বায়ু থলিতে বায়ু সঞ্চিত থাকে এবং শ্বসনের সময় বায়ু প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।

ট্রাকিওল (Tracheole)

ট্রাকিওল কোষ থেকে উৎপন্ন সরু সরু শাখাকে ট্রাকিওল বলে । এদের প্রাচীরে ইন্টিমা ও টিনিডিয়া থাকে না। প্রতিটি শাখার শেষপ্রান্ত তরল পদার্থে পূর্ণ থাকে। একে প্রান্তীয় থলি (End sac) বলে। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রবেশ করে এরা সরাসরি দেহকোষের সংস্পর্শে আসে ।

ঘাসফড়িং-এর রেচনতন্ত্র

রেচনে সাহায্যকারী অঙ্গগুলাে মিলিত হয়ে যে তন্ত্র গঠিত হয় তাকে রেচনতন্ত্র বলে । ঘাসফড়িংয়ের প্রধান রেচন অঙ্গ হলো ম্যালপিজিয়ান নালিকা (Malpighian tubules)। 

এছাড়া ফ্যাট বডি (Fat Body), নেফ্রোসাইট (Nephrocyte), রেক্টাল গ্রন্থি (Rectal gland), বহিঃকঙ্কাল (Exoskeleton) ঘাসফড়িংয়ের রেচন পদার্থ নিষ্কাশনে সাহায্য করে।

ঘাসফড়িং-এর স্নায়ুতন্ত্র ও সংবেদী অঙ্গসমূহ

স্নায়ুতন্ত্র(The nervous system)

স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যে প্রাণী বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উদ্দীপনা গ্রহণ করে এবং সেই অনুযায়ী উপযুক্ত প্রতিবেদন সৃষ্টি করে।

ঘাসফড়িং এর স্নায়ুতন্ত্র তিন ভাগে বিভক্ত। যথাঃ

(১) কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র

(২) প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র এবং

(৩) সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র।

(১) কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র(Central nervous system)

এ স্নায়ুতন্ত্র আবার নিম্নোক্ত অংশ সমন্বয়ে গঠিত। যথাঃ

(i) মস্তিষ্ক স্নায়ু গ্রন্থি (Brain or the Supra Pharyngeal ganglion)

এটি মাথার সম্মুখবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এবং স্নায়ুতন্ত্রের অগ্রবর্তী স্ফীততম অংশ। মস্তিষ্ক দুটো সুপ্রা ইসােফেজিয়াল বা অধিঃগবিলীয় স্নায়ুগ্রন্থির সমন্বয়ে গঠিত। এখান থেকে দুটো স্নায়ু চক্ষুতে, দুটো স্নায়ু শুঙ্গে এবং দুটো স্নায়ু ল্যাবিয়ামে প্রবেশ করে। দেহে সংবেদী অঙ্গগুলাের সাথে মস্তিষ্ক সংবেদী স্নায়ুর মাধ্যমে যুক্ত। এ অংশ সংবেদী অঙ্গের কার্য নিয়ন্ত্রণ করে।

(ii) অধঃগ্রাসনালীয় বা অধঃগলবিলীয় স্নায়ুগ্রন্থি (Subpharyngeal ganglion)

অন্ননালীর নীচে অবস্থিত দুটো সাব- ইসােফেজিয়াল স্নায়ুগ্রন্থি পরস্পর মিলিত হয়ে একটি স্নায়ুগ্রন্থি গঠন করে। এখান থেকে স্নায়ুতন্ত্র মুখোপাঙ্গ, লালাগ্রন্থি ও মাথার পেশীতে প্রবেশ করে। কিছু সংখ্যাক স্নায়ুকোষের দেহ একসাথে।মিলিত হয়ে স্নায়ুগ্রন্থি (Ganglion) গঠিত হয়)।

(iii) পরি—গ্রাসনালীয় স্নায়ু যােজক বা পরিগলবিলীয় স্নায়ুযোজক (Peripharyngeal nerve connective)

মস্তিষ্ক থেকে উৎপন্ন হয়ে একজোড়া পরিগ্রাসনালীয় স্নায়ুযােজক গ্রাসনালীকে বেষ্টন করে মস্তিষ্ক ও অধঃগ্রাসনালীয় স্নায়ুগ্রন্থির মধ্যে সংযোগ ঘটায়। 

(iv) অঙ্কীয় স্নায়ুরজ্জু (Ventral nerve cord)

এক জোড়া স্নায়ুসূত্র পরপর গায়ে গায়ে ঘেঁষে অধঃগ্রাসনালীয় স্নায়ুগ্রন্থির পশ্চাৎ প্রান্ত থেকে দেহের অঙ্কীয় মধ্যরেখা বরাবর পশ্চাৎ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এদেরকে অঙ্কীয় স্নায়ুরজু বলে। এ স্নায়ুরজ্জুতে মোট ১ জোড়া গ্যাংলিয়ন বা স্নায়ুগ্রন্থি আছে। তার মধ্যে তিনজোড়া ৩টি বক্ষখন্ডে এবং ৬ জোড়া উদরের প্রথম ছয়খন্ডে অবস্থিত। বক্ষস্থলের স্নায়ুগ্রন্থি থেকে স্নায়ুতন্তু বের হয়ে বক্ষপেশী, পদ ও পাখায় প্রবেশ করেছে। ৬ষ্ঠ উদরীয় স্নায়ুগ্রন্থি জোড়া সর্বাপেক্ষা বড়। এই গ্রন্থি থেকে কয়েক জোড়া স্নায়ুবের হয়ে পায়ুসারকাস, পায়ু কূর্চ (পুরুষে) ও আনুষঙ্গিক অঙ্গে যায়। [ সুতরাং ঘাসফড়িং এ মােট ১১জোড়া স্নায়ুগ্রন্থি আছে।] 

ঘাসফড়িং-এর সংবেদী অঙ্গসমূহ (SENSE ORGANS)

নিয়ে বর্ণিত সংবেদী অঙ্গসমূহ ঘাসফড়িং এ পরিলক্ষিত হয়

১. স্পর্শ সংবেদী অঙ্গ (ORGAN FOR TOUCH)

অ্যান্টেনা, পায়ুসমূহ এবং কিউটিকলে অবস্থিত রােমসমূহ স্পর্শ সংবেদনশীল ।

২, ঘ্রাণ ও স্বাদ সংবেদী অঙ্গ (ORGAN FOR SMELL AND TASTE)

অ্যান্টেনা, ম্যাক্সিলা এবং ল্যাবিয়াল পাল্পে অবস্থিত সেন্সরি হেয়ার (sensory hair) ঘ্রাণ ও স্বাদ সংবেদী।

৩. শব্দ সংবেদী অঙ্গ (ORGAN FOR RECEIVING SOUND)

ঘাসফড়িং এ প্রথম উদরীয় খন্ডকের প্রতিপার্শ্বে একটি করে একজোড়া শ্রবণ অঙ্গ থাকে। এরা একটি কাইটিন (chitin) নির্মিত রিং এর মধ্যে প্রসারিত টিমপ্যানিক পর্দা (tympanic membrane) সম্বলিত। টিমপ্যানাম (tympanum) এর ভেতরের গাত্রে সাদা, সংবেদী শ্রবণ অঙ্গ (auditory apparatus) থাকে, যাকে মুলারস অঙ্গ (Mullars organ)ও বলে। ঘাসফড়িং পশ্চাৎপদে অবস্থিত টিবিয়াল স্পাইন (tibial spine) ডানার শিরায় ঘসে শব্দ উৎপন্ন করতে পারে ।

৪. আলোক সংবেদী অঙ্গ (ORGANS OF RECEIVING LIGHT) 

ওসেলাসসমূহ এবং পুঞ্জাক্ষী ঘাসফড়িং এর আ্লোক সংবেদী অঙ্গ । প্রতিটি ওসেলাস ও সরলাক্ষী পুরু কিন্তু স্বচ্ছ কিউটিকল নির্মিত লেন্স এবং রেটিনুলার কোষ নিয়ে গঠিত। ওসেলাসমূহ শুধুমাত্র অন্ধকার এবং আলোর পার্থক্য করতে পারে। 

ঘাসফড়িং-এর দর্শন কৌশল

কর্নিয়া, কর্নিয়াজেন কোষ, ক্রিস্টালাইন কোণ, আইরিশ রঞ্জক কোষ ও রেটিনাল রঞ্জক আবরণের মধ্য দিয়ে আলোকে ওমাটিডিয়ামের পরবর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং রেটিনুলার কোষ ও র্যাবডোম অঞ্চলে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়। ঘাসফড়িংয়ের চক্ষুতে উজ্জ্বল আলোকে এক ধরনের এবং স্তিমিত আলোকে আর এক ধরনের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয় । উজ্জ্বল আলোকে যে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয় তাকে অপোজিশন প্রতিবিম্ব এবং স্তিমিত আলোকে যে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয় তাকে সুপারপজিশন প্রতিবিম্ব বলে।

১। অ্যাপোজিশন প্রতিবিম্ব (Apposition image) 

উজ্জ্বল আলোকে ঘাসফড়িং এর প্রতিবিম্ব গঠন পদ্ধতিকে এপপাজিশন বা মোজাইক প্রতিবিম্ব গঠন পদ্ধতিবলে। এই পদ্ধতিতে গঠিত প্রতিবিম্বকে অ্যাপোজিশন প্রতিবিম্ব বা মোজাইক প্রতিবিম্ব বলে। 

প্রক্রিয়া

এ সময় ওমাটিডিয়ামের আইরিস পিগমেন্ট আবরণ প্রসারিত হয়ে র্যাবডোমগুলোকে সম্পূর্ণরূপে আবৃত করে। ফলে প্রতিটি ওমাটিডিয়াম পরস্পর হতে পৃথক হয়ে যায়। বস্তুর অংশ বিশেষ হতে আগত উলম্ব আলোকরশ্মিগুলো ওমাটিডিয়ামে প্রবেশ করে এবং যথাক্রমে কর্ণিয়া ও ক্রিস্টালাইন কোণ  হয়ে র‍্যাবডোমে প্রবেশ করে। কিন্তু তীর্ষক আলোকরশ্মিগুলো কর্ণিয়ার মাধ্যমে প্রবেশ করলেও আইরিশ পিগমেন্ট আবরণ দ্বারা শোষিত হয়। ফলে প্রতিটি ওমাটিডিয়ামে পৃথক পৃথক প্রতিবিম্ব গঠিত হয়। এভাবে কয়েকটি ওমাটিডিয়াম একত্রে কোন বস্তুর আংশিক বা সম্পূর্ণ ও স্পষ্ট প্রতিবিম্ব গঠন করে। দিনের বেলা বা যে কোন সময় উজ্জল আলোতে এ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন প্রতিবিম্ব খুবই স্পষ্ট কিন্তু খন্ডিত হয়। এই প্রতিবিম্বকে মোজাইক প্রতিবিম্ব বা অ্যাপোজিশন প্রতিবিম্ব বলে।

২। সুপারপজিশন প্রতিবিম্ব (Superposition image)

স্তিমিত বা মৃদু আলোতে আরশোলার প্রতিবিম্ব গঠন পদ্ধতিকে সুপারপজিশন প্রতিবিম্ব গঠন পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতিতে গঠিত প্রতিবিম্বকে সুপারপজিশন প্রতিবিম্ব (Super Position) বলে। 

প্রক্রিয়া 

স্থিমিত বা মৃদু আলোকে ওমাটিডিয়ামের আইরিস পিগমেন্ট আবরণ কর্ণিয়ার দিকে এবং রেটিনুলার সীথ নীচের দিকে সংকুচিত হয়। ফলে র‍্যাবডোমের নীচের অংশ ও রেটিনুলার কোষের উপরের অংশ অনাবৃত হয়। বস্তু থেকে আগত উলম্ব আলোক রশ্মিগুলো এদের বরাবর অবস্থিত  ওমাটিডিয়ামগুলোর কর্ণিয়া ও মোচার মধ্য দিয়ে র‍্যাবডোমে পৌছায়। কিন্তু তীর্যক রশ্মিগুলো কোন নির্দিষ্ট ওমাটিডিয়ামের কর্ণিয়ার মধ্য দিয়ে পার্শ্ববর্তী ওমাটিডিয়ামসমূহে প্রবেশ করে। ফলে কোন একটা ওমাটিডিয়ামের র‍্যাবডোমে বস্তুর একাধিক বিন্দু থেকে আগত আলোকরশ্মি পতিত হয় এবং সম্মিলিতভাবে একটি সামগ্রিক, অস্পষ্ট, ও ঝাপ্সা  প্রতিবিম্ব গঠিত হয়। সাধারণতঃ রাতে বা যে কোন সময় স্তিমিত আলোতে ঘাসফড়িং এ প্রক্রিয়ায় দেখে। স্তিমিত আলোকে এই দর্শন প্রক্রিয়াকে সুপারপজিশন দর্শন বলে। 

ঘাসফড়িংএর প্রজননতন্ত্র

ঘাসফড়িং একলিঙ্গ প্রাণী। পুরুষ হতে স্ত্রী ঘাসফড়িংকে তাদের ওভিপোজিটর (ovipositor) এবং উদরের পশ্চাৎ অংশ দেখে সহজেই সনাক্ত করা যায়।

পুং প্রজনন তন্ত্র

একজোড়া শুক্রাশয় (testis, pl. testes) পুং প্রজনন তন্ত্রের প্রধান অঙ্গ। শুক্রাশয় ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম উদরীয় খন্ডকে অন্ত্রের উপরে অবস্থান করে। একটি মিডিয়ান লিগামেন্ট দ্বারা শুক্রাশয় পৃষ্ঠীয় প্রাচীরের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে। প্রতিটি শুক্রাশয় ধারাবাহিকভাবে সজ্জিত লম্বাটে ক্ষুদ্র ফলিকল সমন্বয়ে গঠিত। শুক্রাশয়ে শুক্রাণু উৎপন্ন হয় এবং তা শুক্রাশয় হতে অঙ্কীয় পার্শ্বীয় দিকে উত্থিত ভাস ডিফারেন্স (vas deferens) এ প্রবেশ করে। প্রতিটি ক্রাশয় হতে উত্থিত ভাস ডিফারেন্স নবম উদরীয় খন্ডে অন্ত্রের নিচে মিলিত হয়ে মধ্যরেখা বরাবর পেশিবহুল ক্ষেপন নালি (ejaculatony duct) গঠন করে। ভাস ডিফারেন্স এর শেষাংশ স্ফীত এবং সেমিনাল ভেসিকল (seminal vesicle) নামে পরিচিত। সেমিনাল ভেসিকল শুক্রাণু (spermatozoa) সঞ্চিত রাখে। একজোড়া সহায়ক গ্রন্থি (accessory glands) বা মাশরুম গ্রন্থি (mushroom glands) ক্ষেপন নালিতে উন্মুক্ত হয়। মাশরুম গ্রন্থি নিঃসৃত তরল পদার্থ শুক্রাণু স্থানান্তকরণে (স্ত্রী ঘাস ফড়িং-এ) সহায়তা করে। ক্ষেপন নালি পেনিস (penis) বা ইডেগাস (aedegus) এ উন্মুক্ত হয়।

স্ত্রী প্রজনন তন্ত্র

স্ত্রী ঘাসফড়িং এ একজোড়া ডিম্বাশয় থাকে যা অন্ত্রের উপরে মিডিয়ান লিগামেন্ট (median ligament) দ্বারা পৃষ্ঠীয় প্রাচীরের সাথে আটকানো থাকে। প্রতিটি ডিম্বাশয় (ovary) লম্বাটে এবং ক্রমান্বয়ে সরু বেশ কতকগুলো ওভারিওলস (ovarioles) বা অণুডিম্বাশয় দ্বারা গঠিত। প্রতিটি ওভারিওল সারিবদ্ধভাবে সজ্জিত বর্ধনশীল ডিম্বক বহন করে। ডিম্বনালি দুইটি একত্রিত হয়ে একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ গঠন করে। একে যোনি (vagina) বলে। যোনি ওভিপজিটরের (ovipositor) মাধ্যমে বাহিরে উন্মুক্ত হয়। যোনির অদূরে অবস্থিত স্পার্মাথিকা (spermtheca) বা সেমিনাল রিসেপ্টেকল (secminal receptacle) হতে স্বতন্ত্র নালি যোনিতে উন্মুক্ত হয়। যোনির সাথে সংযুক্ত সহায়ক গ্রন্থি (accessory gland)কে কোল্যাটেরিয়াল গ্রন্থি (colleterial gland) বলে। কোল্যাটেরিয়াল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ ডিম পাড়ার পর ডিমগুলোকে একত্রে রাখতে সহায়তা করে। স্পার্মাথিকায় শুক্রাণু সঞ্চিত থাকে। 

ঘাসফড়িং-এর রূপান্তর

কোন প্রাণীর জীবনচক্রে কিছু ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যখন লার্ভা দশা থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে পরিণত হয় তখন তাকে রূপান্তর(Metamorphosis) বলে। যেমন- ঘাসফড়িং, ব্যাঙ, তেলাপোকা, প্রজাপতি ইত্যাদি।

রূপান্তর দুই প্রকার।

১। সম্পূর্ণ রূপান্তর (Complete metamorphosis)-এর চারটি ধাপ থাকে।

ডিম ➡️ লার্ভা ➡️ পিউপা ➡️ইমাগো(পূর্ণাঙ্গ প্রাণী)।

ডিম ফুটে যে শিশু প্রাণী বের হয় তাকে লার্ভা বলে। এদের শিশু প্রাণী এবং পূর্ণাঙ্গ প্রাণী দেখতে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম হয়।

২। অসম্পূর্ণ রূপান্তর (Incomplete metamorphosis)-এর তিনটি ধাপ থাকে।

ডিম ➡️ নিম্ফ ➡️ইমাগো(পূর্ণাঙ্গ প্রাণী)।

ডিম ফুটে যে শিশু প্রাণী বের হয় তাকে নিম্ফ বলে। এদের শিশু প্রাণী এবং পূর্ণাঙ্গ প্রাণী দেখতে প্রায় একই রকম হয়।

ঘাসফড়িং-এর ব্যবহার

ঘাসফড়িংগুলিকে মাঝে মাঝে শিল্পকর্মে চিত্রিত করা হয়, যেমন ডাচ গোল্ডেন এজ পেন্টার বাল্থসার ভ্যান ডার এস্টের স্টিল লাইফ অয়েল পেইন্টিং, শাঁস এবং কীটপতঙ্গ সহ ফুলদানি। ঘাসফড়িং সিনেমাতেও প্রদর্শিত হয়। ১৯৯৯ সালে ডিজনি / পিক্সার অ্যানিমেটেড ফিল্ম এ বাগের লাইফে, বিরোধীরা একটি ঘাসফড়িং এর দল, যার নেতা হপার প্রধান খলনায়ক হিসাবে কাজ করছেন। ঘাসফড়িংগুলি কখনও কখনও প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। গ্রীক প্রত্নতাত্ত্বিক যুগের সময়, ঘাসফড়িং অ্যাথেন্সের পোলিসের প্রতীক ছিল।

মানুষের খাদ্য হিসেবে ঘাসফড়িং

কিছু দেশে,ঘাসফড়িংকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ মেক্সিকোয়, চ্যাপুলিন নামে পরিচিত ফড়িংগুলি বিভিন্ন ধরণের খাবারে খাওয়া হয়, যেমন মরিচের সসযুক্ত টরটিলে। ডুঙ্গুয়ামেন নাইট মার্কেটের মতো কয়েকটি চীনা খাবারের বাজারগুলিতে ঘাসফড়িংগুলি স্কিওয়ারে পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে ঘাসফড়িং খাবার প্রচলন আছে।

শেয়ার:

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × 2 =