বিশ্বগ্রাম

বিশ্বগ্রাম (Global Village)

গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রামে গোটা পৃথিবীকে একটি গ্রাম হিসেবে কল্পনা করা হয়। একটি গ্রামের সকল মানুষ যেমন খুব সহজেই তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, তেমনি এখন পৃথিবীর সকল মানুষ খুব সহজেই নানা ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে। সুতরাং, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বকেই বিশ্বগ্রাম বলা হয়। 

কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিখ্যাত দার্শনিক মার্শাল ম্যাকলুহান সর্বপ্রথম গ্লোবাল ভিলেজ কথাটি ব্যবহার করেন, এজন্য তাকে বিশ্বগ্রামের জনক বলা হয়। তাহলে আমরা বলতে পারি, বিশ্বগ্রাম হচ্ছে এমন একটি পরিবেশ যেখানে পৃথিবীর সকল মানুষই একটি একক সমাজে বসবাস করে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একে অপরকে সেবা প্রদান করে থাকে।

এবার চলো বিশ্বগ্রামের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বিশ্বগ্রাম এর সুবিধা:

  • স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী নিরাপদ ও দ্রুত যোগাযোগ করা যায়।
  • থিবীব্যাপী তথ্যের ব্যাপক উৎস সৃষ্টি হয়েছে এবং তথ্য পাওয়া সহজলভ্য হয়েছে।
  • প্রযুক্তি গ্রহণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার এবং লেনদেন সহজ ও দ্রুততর হচ্ছে।
  • ঘরে বসেই শিক্ষা গ্রহণ, উন্নত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

বিশ্বগ্রাম এর অসুবিধা:

  • ইন্টারনেট প্রযুক্তির ফলে অনেক ক্ষেত্রে তথ্যের গোপনীয়তা বজায় থাকছে না।
  • সহজেই অসত্য বা মিথ্যা এবং বানোয়াট সংবাদ ছড়িয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
  • প্রযুক্তি পরিবর্তনের কারণে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক শেয়ার করার জন্য অনুন্নত দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
  • সাইবার আক্রমণ বাড়ছে।

এখন আমরা বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার প্রধান উপাদানসমূহ নিয়ে আলোচনা করবো।

বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার উপাদান:

হার্ডওয়্যার:

বিশ্বগ্রামে যেকোনো ধরণের যোগাযোগের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত হার্ডওয়্যার। যেমন: কম্পিউটার এবং পেরিফেরাল যন্ত্রপাতি, মোবাইল, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি।

সফটওয়্যার:

বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্য হার্ডওয়্যার এর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার প্রয়োজন। এসকল সফটওয়্যার দিয়েই সাধারণত হার্ডওয়্যার চালানো হয়। অপারেটিং সিস্টেম, ব্রাউজিং সফটওয়্যার, কমিউনিকেশন সফটওয়্যার হলো বিভিন্ন ধরণের সফটওয়্যারের উদাহরণ।

নেটওয়ার্ক বা কানেক্টিভিটি:

বিশ্বগ্রামের মেরুদণ্ড হলো নেটওয়ার্ক বা কানেকটিভিটি, যার মাধ্যমে তথ্য বা ডেটা বিশ্বগ্রামের প্রতিটি মানুষের নিকট পৌছায়।

ডেটা বা ইনফরমেশন:

ডেটা প্রক্রিয়াকরণ পরবর্তী অর্থপূর্ণ রূপ হলো ইনফরমেশন বা তথ্য। বিশ্বগ্রামে এই ডেটা বা ইনফরমেশন, মানুষের প্রয়োজনে একে অপরের সাথে শেয়ার করা হয়।

মানুষের সক্ষমতা:

বিশ্বগ্রাম মূলত তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থা। তাই বিশ্বগ্রাম বাস্তবায়নের জন্য মানুষের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবকাঠামো ব্যবহারের সক্ষমতা থাকতে হবে।

এখন চলো বিশ্বগ্রামের উপাদানসমূহ সম্পর্কে জানা যাক।

বিশ্বগ্রাম এর উপাদানসমূহ:

যোগাযোগ:

যোগাযোগ বিশ্বগ্রামের অন্যতম একটি উপাদানপ্রাচীনকালে আমরা চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করতাম। পরবর্তীতে তারযুক্ত ফোন এবং ফ্যাক্স আসার পর টেলিফোনের প্রচলন শুরু হয়। এভাবে প্রযুক্তির বিবর্তনের ফলে আসে তারবিহীন মোবাইল ফোন যার মাধ্যমে পুরো বিশ্ব এসে পড়েছে হাতের মুঠোয়। সেই সাথে ইমেইল, টেলিকনফারেন্সিং, ভিডিও কনফারেন্সিং এবং বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে তথ্যের আদান প্রদান করা যায়। আর, যোগাযোগের এই ব্যাবস্থাকে টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য যোগাযোগ এই দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়: 

১) টেলিযোগাযোগ:

টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি।

২) তথ্য যোগাযোগ:

ইমেইল, টেলিকনফারেন্সিং, ভিডিও কনফারেন্সিং ইত্যাদি।

রিজার্ভেশন সিস্টেম:

বিশ্বগ্রাম ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে রিজার্ভেশন সিস্টেম দিয়ে সশরীরে উপস্থিত না থেকে ঘরে বসেই ইন্টারনেটের সাহায্যে বাস,প্লেন, ট্রেন থেকে শুরু করে হোটেল, রেস্টুরেন্ট সহ আরও অনেক কিছুর বুকিং দেয়া যায়।

কর্মসংস্থান:

বর্তমানে ইন্টারনেটে বিভিন্ন ধরণের জব-পোর্টাল রয়েছে যার মাধ্যমে সহজেই ঘরে বসে চাকুরির খবর পাওয়া, আবেদন করা, ইন্টারভিউ দেয়া এবং যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা যায়। আবার গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এর মতো নানা ধরণের ব্যক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে অনেকে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে যাদের ফ্রিল্যান্সার বলে। এছাড়া, প্রযুক্তির ছোয়ায় ফুড ডেলিভারি কিংবা রাইড শেয়ারিং এর মতো বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক সংস্থা আসার ফলে বেড়েছে মানুষের কর্মসংস্থান।

শিক্ষা:

বিশ্বগ্রাম ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ঘরে বসেই শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করা যায়। সেই সাথে ইন্টারনেটে রয়েছে ভিডিও টিউটোরিয়াল, অনলাইন কোর্স ও বিভিন্ন ডিজিটাল কন্টেন্ট, যার মাধ্যমে খুব সহজেই জটিল বিষয়গুলো আয়ত্ত করা যায়।  এছাড়াও, বিশ্বগ্রামের উন্নয়নের ফলে শিক্ষার্থীরা এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্বের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে।

চিকিৎসা:

এখন ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে দেশের কিংবা বিদেশের দক্ষ চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা ও পরামর্শের মতো সেবা গ্রহণ করা যায় যাকে টেলিমেডিসিন বলে।

গবেষণা:

আগে যেসকল কাজে গবেষণা করতে বছরের পর বছর লেগে যেতো, বিশ্বগ্রামের কল্যাণে বর্তমানে তা খুব সহজেই করা যায়। পদার্থের অনু-পরমানুর গঠন, রাসায়নিক দ্রবের বিশ্লেষণ, বিশাল আকারের জটিল গাণিতিক হিসাব-নিকাশ, মহাকাশ সম্পর্কিত গবেষণা, যানবাহনের গঠন তৈরির মতো নানা ধরণের গবেষণায় বিজ্ঞানীরা কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও ইন্টারনেটে গবেষণা সংক্রান্ত খবর, তথ্য ও উপাত্ত পাওয়া যায় দেখে গবেষণা কর্মের পুনরাবৃতি ঘটেনা। ফলে নতুন গবেষণার প্রসার বৃদ্ধি পায়।

অফিস:

প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে অফিসে বিভিন্ন রকমের অটোমেশন ও কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করা হচ্ছে যা দিয়ে সহজেই সম্পূর্ণ অফিসের ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, নানা ধরণের হিসাব করা কিংবা ডকুমেন্ট লেখা যায়। অফিস সংক্রান্ত সকল তথ্য ও উপাত্ত ডেটাবেজে সংরক্ষন করা হয়ে থাকে যার ফলে ডেটা হারানোর ভয় থাকেনা। 

বাসস্থান:

বিশ্বগ্রামের অন্যতম উপহার হলো স্মার্ট হোম, যা আমাদের জীবনযাত্রার মানকে অনেক বেশি সহজ ও উন্নত করে তোলে। যে বাসস্থানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেটের মতো ঘড়ের ইউটিলিটি ও এসি, লাইট,ফ্যানের মতো বিভিন্ন গৃহস্থালি জিনিসপত্র নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাকে স্মার্ট হোম বলে।

ব্যবসা-বানিজ্য:

তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের কল্যানে এখন অনেক ব্যবসাই কম্পিউটারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করা যায়। ফ্যাক্টরিতে ম্যানুফ্যাকচারিং, প্যাকেট লেবেলিং, প্যাকেজিং, কম্পিউটারাইজড মেশিনের মাধ্যমে নির্ভুল ভাবে করা যায়। ডেটাবেজ ব্যবহার করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সকল তথ্য নিরাপদভাবে দীর্ঘদিন সংরক্ষন করা যায়। এছাড়াও, শেয়ার বাজারও ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করা যায়।

ই-কমার্স ও ইলেক্টনিক ফান্ড ট্রান্সফার:

আজকের ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের যুগে ই-কমার্স হয়ে উঠেছে অত্যাবশ্যকীয় ও জনপ্রিয়। এর ফলে তুমি বিভিন্ন ধরণের ই-কমার্স সাইট থেকে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় সকল ধরনের পণ্য অর্ডার দিয়ে কিনতে পারো। তাছাড়াও বর্তমানে ইলেক্টনিক ফান্ড ট্রান্সফার ব্যবহার করে নিরাপদে আসল অর্থের পরিবর্তে চুম্বককালি বিশিষ্ট এটিএম কার্ড দিয়ে অর্থের লেন-দেন ও স্থানান্তর করা যায়।

সংবাদ:

ইন্টারনেট ও কমিউনিকেশন ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে, স্যাটেলাইটের সাহায্যে এখন সরাসরি নিউজ বা সংবাদের প্রোগ্রাম দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা যাচ্ছে। ফলে সংবাদ পত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনের সাথে মোবাইল কিংবা কম্পিউটার ব্যবহার করে খুব সহজেই বিভিন্ন স্থান থেকে সংবাদ পাওয়া যায়।

বিনোদন ও সামাজিক যোগাযোগ:

বিনোদন ও সামাজিক যোগাযোগে বিশ্বগ্রামের ভূমিকার শেষ নেই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন ঘরে বসেই নাটক ও সিনেমা দেখা, গান শোনা কিংবা অনলাইনে গেমস খেলা যায়। আবার, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে খুব সহজেই দূর-দূরান্তের বন্ধুদের ও আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিত মানুষদের সাথে যোগাযোগ কিংবা ছবি শেয়ার করে সামাজিকতা রক্ষা করা যায়।

সাংস্কৃতিক বিনিময়: 

বর্তমানে নিজ দেশে বসে সামাজিক মাধ্যম কিংবা ইন্টারনেট ওয়েবসাইট থেকে যেকোনো দেশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান ও নাটক দেখে তাদের সংস্কৃতি কিংবা জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এছাড়াও, ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পুরো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা যায়। এভাবেই বিশ্বগ্রাম ও প্রযুক্তির কল্যাণে বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে থাকে।

শেয়ার:

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight + 20 =