Classification-of-animals

প্রাণী শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তি

যেকোনো প্রাণী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা পেতে প্রথমেই যেটি প্রয়োজন তা হলে শনাক্তকরণ। এর জন্যই চাই শ্রেণিকরণ বা প্রাণী শ্রেণিবিন্যাস। 

প্রাণী শ্রেণীবিন্যাসের ইতিহাস 

তাহলে কখন থেকে প্রাণী শ্রেণীবিন্যাসের কাজ শুরু হয়। প্রাণীবিজ্ঞান চর্চার শুরু থেকে অনেক বিজ্ঞানী প্রানীদের শ্রেণীবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল(৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্টপূর্ব)। তাকে প্রাণীবিদ্যার জনক বলা হয়। তিনিই শ্রেণীবিন্যাসের ভিত্তি রচনার সুত্রপাত করেন।

অ্যারিস্টটল(৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্টপূর্ব)

অ্যারিস্টটল প্রাণীদের রক্তের রং ও মেরুদণ্ডের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করেন Enaima ও Anaima। তিনি লাল রক্তযুক্ত মেরুদন্ডী প্রাণীদের Enaima এবং লাল রক্তবিহীন অমেরুদন্ডী প্রাণীদের Anaima হিসেবে ভাগ করেন। তার পরবর্তীতে জন রে (১৬২৭-১৭০৫) একটি উন্নত মানের স্রেণীবিন্যাস প্রবর্তন করেন।

জন রে (১৬২৭-১৭০৫)

শ্রেণীবিন্যাস বিদ্যার জনক 

ক্যারোলাস লিনিয়াস (১৭০৭-১৭৭৯৮)

সুইডিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস (১৭০৭-১৭৭৯৮) বিজ্ঞানভিত্তিক ও সুসংবদ্ধ উপায়ে প্রাণিদের সর্বপ্রথম শ্রেণিবিন্যাস করেন। তিনি তার Systema Naturae নামক পুস্তকের দশম সংস্করণে (1758) দ্বিপদ নামকরণের পদ্ধতি সর্বপ্রথম প্রবর্তন ও সঙ্গতভাবে ব্যবহার করেন। তাই পরবর্তীতে শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতিতে বহু পরিবরতন সত্ত্বেও তাকে শ্রেণীবিনাস বিদ্যার জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। 

প্রাণী শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তি

যে সকল সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে প্রাণীর শ্রেণীবিন্যাস করা হয় তাকে প্রাণীর শ্রেণীবিন্যাস বিষয়ক বৈশিষ্ট্য (Taxonomic characteristics) বলা হয়। বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাণীর আকৃতি, দৈহিক গঠন, প্রতিসাম্যতা, দেহের খণ্ডায়ন, দেহ-গহ্বর, লিঙ্গ, জীবনচক্র প্রভৃতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

বর্তমানে প্রচলিত প্রাণী শ্রেণীবিন্যাস যেসব বিষয়াবলীর উপর ভিত্তিকরে তৈরি করা হয়েছে সেগুলো নিচে দেয়া হল-

১। কোষের সংখ্যা:

কোষের সংখ্যার উপর ভিত্তিকরে সমগ্র প্রাণীজগতকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  • এককোষী প্রাণী:

যে সকল প্রাণী একটি মাত্র কোষ নিয়ে গঠিত তাদের এককোষী বা অকোষী (Unicellular or Acellular) প্রাণী বলে। এরা প্রোটোজোয়া (Protozoa) দলের বা পর্বের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- অ্যামিবা, ইউগ্লেনা ইত্যাদি।

অ্যামিবা  

ইউগ্লেনা                                

  • বহুকোষী প্রাণী:

যেসকল প্রাণী একাধিক কোষ নিয়ে গঠিত তাদের বহুকোষী (Multicellular) প্রাণী বলে। এরা মেটাজোয়া (Metazoa) দলের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- মাছ, মানুষ ইত্যাদি।

মাছ 

মানুষ  

২। কোষের সংগঠন:

পৃথিবীতে যেমন অ্যামিবার মত এককোষী প্রাণী রয়েছে তেমনই তিমির মত বৃহদাকার বহুকোষী প্রাণীও বর্তমান। তবে সকল বহুকোষী প্রাণীই কলা বা অঙ্গ বা অঙ্গতন্ত্র গঠন করে না।  বহুকোষী প্রাণীদের কোষসমূহের কলা, অঙ্গ বা অঙ্গতন্ত্র গঠন করার মাত্রার উপর ভিত্তি করে এদেরকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যায়। যথা-

  • প্রোটোপ্লাজমিক স্তর:

এই স্তরের প্রাণীগুলো একটি মাত্র কোষ নিয়ে গঠিত যার মাধ্যমে এরা এদের সকল জৈবিক কার্যাবলী সম্পন্ন করে থাকে। প্রোটোজোয়া (Protozoa) পর্বের প্রাণীসমূহ এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- অ্যামিবা, ইউগ্লেনা ইত্যাদি।

অ্যামিবা  

ইউগ্লেনা                                

  • কোষীয় স্তর:

এই স্তরের প্রাণীগুলো একাধিক কোষ নিয়ে গঠিত হলেও এদের দেহে কোন প্রকার কলা দেখতে পাওয়া যায় না। তবে অনেক প্রাণীতে একাধিক কোষের মাঝে বিভিন্ন মাত্রায় শ্রম বণ্টন দেখতে পাওয়া যায়। পরিফেরা (Porifera) পর্বের প্রাণীসমূহ এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- স্কাইফা, স্পঞ্জিলা ইত্যাদি।

স্কাইফা

স্পঞ্জিলা

  • কলা স্তর:

এই স্তরের প্রাণীরা বহুকোষী এবং এদের কোষসমূহ একত্রিত গুচ্ছে বিভক্ত হয়ে কলা গঠন করে বিভিন্ন জৈবিক কার্যাবলী সম্পন্ন করে থাকে। তবে এই কলাগুলো কোন অঙ্গ বা অঙ্গতন্ত্র গঠন করে না। নিডোরিয়া (Cnidaria) পর্বের প্রাণীসমূহ এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- হাইড্রা, ওবেলিয়া ইত্যাদি।

হাইড্রা

ওবেলিয়া

  • অঙ্গ স্তর:

এই স্তরের প্রাণীদের বিভিন্ন ধরণের কলা বর্তমান এবং কলাসমূহ একত্রিত হয়ে প্রবোসিস, জননাঙ্গ ইত্যাদি অঙ্গ গঠন করে প্রয়োজনীয় জৈবিক কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে। তবে এই অঙ্গ বা অঙ্গসমূহ কোন অঙ্গতন্ত্র গঠন করে না। প্লাটিহেলমিনথিস (Platyhelminthes) পর্বের প্রাণীসমূহ এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- Planaria ইত্যাদি।

প্লেনেরিয়া

  • অঙ্গতন্ত্র স্তর:

এই স্তরের প্রাণীদের অঙ্গসমূহ একত্রিত হয়ে অঙ্গতন্ত্র গঠন করে প্রয়োজনীয় জৈবিক কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে। প্রতিটি অঙ্গতন্ত্র সুনির্দিষ্ট কাজের সাথে জড়িত। নেমাটোডা, অ্যানিলিডা, আর্থ্রোপোডা, মোলাস্কা, একাইনোডার্মাটা ও কর্ডাটা পর্বের প্রাণীদের বিভিন্ন ধরণের অঙ্গতন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়।

কর্ডাটা পর্বের প্রাণী

৩। জীবন পদ্ধতি(Way of living):

প্রাণীরা কিভাবে জীবন জাপন করে সেই পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে প্রাণীকূলকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। 

  • মুক্তজীবী জীব (Free living):

এই ধরনের প্রাণীরা মুক্তভাবে জীবন যাপন করে। বেঁচে থাকার জন্য কারো উপর নির্ভরশীল নয়। এদের মধ্যে রয়েছে কবুতর । 

কবুতর 

  • পরজীবী জীব (Parasite ):

এইসব প্রাণী প্রধানত খাদ্যের জন্য অন্য প্রাণীর উপর নির্ভর করে এবং আশ্রয় গ্রহণ করে। এরা  আশ্রয়দাতা জীবেরদেহ থেকে খাদ্য শোষণ করে।   এদের মধ্যে অন্যতম কৃমি যা মানুষের অন্ত্রে পরজীবী হিসিবে বাস করে। 

 কৃমি

৪। ভ্রূণস্তর (Germ/Germinal layers):

পরিণত প্রাণীর বিভিন্ন কলা ও অঙ্গ ভ্রূণের যে কোষস্তর থেকে তৈরি হয় তাকে ভ্রূণস্তর বলে। ভ্রূণের কোষ প্রাণী ভেদে দুই বা তিন স্তরে সজ্জিত থাকে।

  • দ্বিস্তরবিশিষ্ট (Diploblastic) প্রাণী:

যাদের ভ্রূণে দুটি কোষস্তর থাকে তাকে দ্বিস্তরবিশিষ্ট (Diploblastic) প্রাণী বলে। স্তরগুলো হচ্ছে- বহিঃস্তর বা এক্টোডার্ম (Ectoderm) এবং অন্তঃস্তর বা এন্ডোডার্ম (Endoderm)। নিডোরিয়া (Cnidaria) পর্বের প্রাণীসমূহের ভ্রূণে দুটি কোষস্তর থাকে তাই এরা দ্বিস্তরবিশিষ্ট প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন- হাইড্রা, ওবেলিয়া ইত্যাদি।

    হাইড্রা

  • ত্রিস্তরবিশিষ্ট (Triploblastic) প্রাণী:

যাদের ভ্রূণে তিনটি কোষস্তর থাকে তাদের ত্রিস্তরবিশিষ্ট (Triploblastic) প্রাণী বলে। স্তরগুলো হচ্ছে- বহিঃস্তর বা এক্টোডার্ম (Ectoderm), অন্তঃস্তর বা এন্ডোডার্ম (Endoderm) এবং মধ্যস্তর বা মেসোডার্ম (Mesoderm)। 

প্লাটিহেলমিনথিস (Platyhelminthes) থেকে কর্ডাটা (Chordata) পর্বের প্রাণীসমূহের ভ্রূণে তিনটি কোষস্তর থাকে অর্থাৎ ত্রিস্তরবিশিষ্ট প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন- Planaria, গোলকৃমি, চিংড়ি, ব্যাঙ, মাছ, কুমির, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ইত্যাদি।

ব্যাঙ

৫। সিলোম (Coelom):

প্রাণীদেহের দেহ প্রাচীরের প্যারাইটাল আবরণী ও পৌষ্টিকনালির ভিসেরাল আবরণীর মধ্যবর্তী স্থানের তরলে পূর্ণ গহ্বরকে সিলোম বলে। এটি ভ্রূণীয় মেসোডার্ম থেকে উদ্ভূত হয়। সিলোম দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহ ধারণ করা ছাড়াও সংবহন, বর্জ্য পদার্থ ধারণ ও নিষ্কাশন ইত্যাদি কাজে সহায়তা করে। সিলোমের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে প্রাণীদের কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

  • সিলোমবিহীন বা অ্যাসিলোমেট (Acoelomate) প্রাণী:

যেসব প্রাণীর দেহাভ্যন্তরে তরলে পূর্ণ গহ্বরের পরিবর্তে অন্ত্র ও অন্যান্য অঙ্গ এবং বিভিন্ন ধরনের কোষ বা কলায় পরিপূর্ণ থাকে তাদেরকে সিলোমবিহীন বা অ্যাসিলোমেট প্রাণী বলে। অর্থাৎ এদের সিলোম অনুপস্থিত। যেমন- জেলিফিশ, ফিতাকৃমি ইত্যাদি।

অপ্রকৃত সিলোম বিশিষ্ট বা সিউডোসিলোমেট (Pseudocoelomate) প্রাণী:

যেসব প্রাণীর দেহাভ্যন্তরে তরলে পূর্ণ গহ্বর উপস্থিত কিন্তু তা প্যারাইটাল আবরণী ও ভিসেরাল আবরণী দ্বারা আবৃত নয় তাদেরকে অপ্রকৃত সিলোম বিশিষ্ট প্রাণী বা সিউডোসিলোমেট প্রাণী বলে। এজাতীয় সিলোমে মেসোডার্মাল আবরণ (প্যারাইটাল আবরণী ও ভিসেরাল আবরণী) অনুপস্থিত থাকায় একে প্রকৃত সিলোম হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। নিমাটোডা (Nematoda) পর্বের প্রাণীসমূহে অপ্রকৃত সিলোম দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- গোল কৃমি ইত্যাদি।

  • প্রকৃত সিলোম বিশিষ্ট বা ইউসিলোমেট (Eucoelomate) প্রাণী:

যেসব প্রাণীর দেহাভ্যন্তরে দেহ প্রাচীরের প্যারাইটাল আবরণী ও পৌষ্টিকনালির ভিসেরাল আবরণীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে তরলে পূর্ণ গহ্বর তথা প্রকৃত সিলোম বিদ্যমান তাদেরকে প্রকৃত সিলোম বিশিষ্ট প্রাণী বা ইউসিলোমেট প্রাণী বলে। অ্যানিলিডা (Annelida) থেকে কর্ডাটা (Chordata) পর্বের প্রাণীসমূহে প্রকৃত সিলোম দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- মাছ, মানুষ ইত্যাদি।

৬। প্রতিসাম্যতা (Symmetry):

প্রাণীদেহের কেন্দ্রীয় অক্ষের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত এক বা একাধিক তল বরাবর এক বা একাধিক বার ছেদ করে প্রাণীদেহকে সমভাবে ভাগ করার বিষয়টিই হচ্ছে প্রতিসাম্যতা। অধিকাংশ প্রাণীদেহে এরূপ সমবণ্টন দেখতে পাওয়া গেলেও তা একই ধরণের নয়। প্রধানত চার ধরণের প্রতিসাম্যতা দেখতে পাওয়া যায়। যথা-

  • গোলীয় প্রতিসাম্যতা (Spherical symmetry):

যখন কোন প্রাণীদেহের কেন্দ্রীয় অক্ষের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত একাধিক তল বরাবর একাধিক বার প্রাণীদেহকে সমভাবে ভাগ করা যায় তখন তাকে গোলীয় প্রতিসাম্যতা বলে। যেমন- ভলভক্স।

  • অরীয় প্রতিসাম্যতা (Radial symmetry):

যখন কোন প্রাণীদেহের কেন্দ্রীয় অক্ষের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত একটি তল বরাবর ছেদ করে দুই বা ততোধিক বার প্রাণীদেহকে সমভাবে ভাগ করা যায় তখন তাকে অরীয় প্রতিসাম্যতা বলে। যেমন- হাইড্রা।

  • দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসাম্যতা (Bilateral symmetry):

যখন কোন প্রাণীদেহের কেন্দ্রীয় অক্ষের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত একটি তল বরাবর ছেদ করে কেবলমাত্র একবার প্রাণীদেহকে সমভাবে দুই ভাগ করা যায় তখন তাকে দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসাম্যতা বলে। যেমন- মাছ, মানুষ ইত্যাদি।

  • দ্বিঅরীয় প্রতিসাম্য (Biradial symmetry): 

কোনো প্রাণীদেহে যখন কোন অঙ্গের সংখ্যা একটি কিংবা একজোড়া হওয়ায় অনুদৈর্ঘ্য অক্ষ বরাবর শুধু দুটি তল পরস্পর সমকোণে অতিক্রম করতে পারে। ফলে ওই প্রাণীদেহ চারটি সমান অংশে বিভক্ত হয়।এ ধরনের প্রতিসাম্যকে দ্বিঅরীয়  প্রতিসাম্য বলে। Ctenophora (টিনোফোরা) জাতীয় প্রাণীর দেহ

  • অপ্রতিসাম্যতা (Asymmetry):

যখন কোন প্রাণীদেহের কেন্দ্রীয় অক্ষের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত তল বরাবর ছেদ করে প্রাণীদেহকে একবারও সমভাবে ভাগ করা যায় না তখন তাকে অপ্রতিসাম্যতা বলে। যেমন- অ্যামিবা, শামুক ইত্যাদি।

৭। প্রান্তিকতা ও সেফালাইজেশন (Cephalization):

প্রাণী চলার সময় তার দেহের বিভিন্ন প্রান্ত বিভিন্ন দিকে সুনির্দিষ্ট থাকার বিষয়টি হচ্ছে প্রান্তিকতা। অন্যদিকে প্রাণীদেহের সম্মুখ প্রান্তে মস্তক গঠিত হবার বিষয়টিই হচ্ছে সেফালাইজেশন।

  • সম্মুখ (Anterior) অঞ্চল:

প্রাণী চলার সময় যে প্রান্তটি সামনের দিকে থাকে তাকে সম্মুখ (Anterior) প্রান্ত বলে।

  • পশ্চাৎ (Posterior) অঞ্চল:

প্রাণী চলার সময় যে প্রান্তটি পেছনের দিকে থাকে তাকে পশ্চাৎ (Posterior) প্রান্ত বলে।

  • পৃষ্ঠীয় (Dorsal) অঞ্চল:

প্রাণী চলার সময় সে প্রান্তটি ভূমির বিপরীত দিকে থাকে তাকে পৃষ্ঠীয় (Dorsal) প্রান্ত বলে।

  • অঙ্কীয় (Ventral) অঞ্চল:

প্রাণী চলার সময় সে প্রান্তটি ভূমির দিকে থাকে তাকে অঙ্কীয় (Ventral) প্রান্ত বলে।

  • পার্শ্বীয় (Lateral) অঞ্চল:

প্রাণী চলার সময় সে প্রান্তটি পৃষ্ঠ-অঙ্কীয় রেখার সাথে ৯০ ডিগ্রী কৌণিক অবস্থানে তথা পাশে থাকে তাকে পার্শ্বীয় (Lateral) প্রান্ত বলে।

  • বক্ষীয় (Pectoral) অঞ্চল:

প্রাণীর অগ্রপদের অবলম্বন প্রদানকারী অঞ্চলকে বক্ষীয় (Pectoral) অঞ্চল বলে

  • শ্রোণীয় (Pelvic) অঞ্চল:

পশ্চাৎপদের অবলম্বন প্রদানকারী অঞ্চলকে শ্রোণীয় (Pelvic) অঞ্চল বলে।

৮। তল (Planes):

প্রতিসম প্রাণীতে দৈহিক তল শ্রেণীবিন্যাসের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। যে অঞ্চল বরাবর প্রাণীর দেহকে সমান দুই ভাগে ভাগ করা যায় তাকে তল বলে।

  • স্যাজিটাল (Sagittal) তল:

প্রাণীদেহের কেন্দ্রীয় অক্ষ বরাবর যে কাল্পনিক তল প্রাণীদেহকে ডান ও বাম অংশে বিভক্ত করে তাকে মধ্যরেখীয় বা স্যাজিটাল (Sagittal) তল বলে।

  • ফ্রন্টাল (Frontal) তল:

প্রাণীদেহের কেন্দ্রীয় অক্ষ বরাবর যে কাল্পনিক তল প্রাণীদেহকে পৃষ্ঠীয় (Dorsal) ও অঙ্কীয় (Ventral) অংশে বিভক্ত করে তাকে ফ্রন্টাল (Frontal) তল বলে।

  • ট্রান্সভার্স (Transverse) তল:

প্রাণীদেহের কেন্দ্রীয় অক্ষ বরাবর যে কাল্পনিক তল প্রাণীদেহকে সম্মুখ (Anterior) ও পশ্চাৎ (Posterior) অংশে বিভক্ত করে তাকে অনুপ্রস্থ বা ট্রান্সভার্স (Transverse) তল বলে।

৯। খণ্ডায়ন বা খণ্ডকায়ন (Metamerism):

অনুদৈর্ঘ্য বরাবর প্রাণীদেহের একই রকম খণ্ডাংশ নিয়ে গঠিত হবার বিষয়টিই হচ্ছে খণ্ডায়ন বা খণ্ডকায়ন।

  • সমখন্ডাকায়ন (Homonomous metamere):

সমখন্ডকায়ন হলো যেসব প্রাণীর দেহ খন্ডকগুলো সমান বা একই ধরনের হয়।

  • অসমখন্ডকায়ন(Heteronomous metamere):

যেসব প্রাণীর দেহ খন্ডকগুলো অসম বা ভিন্ন ধরনের হয় তাদেরকে অসমখন্ডকায়ন বলে।

  • খন্ডকায়নবিহীন(Asegmental): 

যেসব প্রাণীতে কোন খণ্ডকায়ন নেই  তাদের খন্ডকায়নবিহীন প্রাণী বলে।

১০। ভ্রূণের রূপান্তর (Embryonic Development):

  • প্রোটোস্টোমিয়া (Protostomia):

এদের পরিণত প্রাণীর মুখছিদ্র ভ্রূণীয় ব্লাস্টোপোর (Blastopore) থেকে অথবা এর নিকটেই সৃষ্টি হয়। পায়ুছিদ্র নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। প্লাটিহেলমিনথিস থেকে মোলাস্কা পর্বের প্রাণীরা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।

  • ডিউটারোস্টোমিয়া (Deuterostomia):

এদের পরিণত প্রাণীর পায়ুছিদ্র ভ্রূণীয় ব্লাস্টোপোর (Blastopore) থেকে অথবা এর নিকটেই সৃষ্টি হয়। মুখছিদ্র নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। একাইনোডার্মাটা ও কর্ডাটা পর্বের প্রাণীরা এদের অন্তর্ভুক্ত।

১১। পরিস্ফুটন ধাপ ও জীবনচক্র (Developmental stage and Life cycle)

প্রাণীর পরিস্ফুটনের পর্যায়কে বৃহৎ পরিসরে দুটি দশায় ভাগ করা যায়। সকল প্রাণীতে এই দুটি দশা একই সময় দেখা যায় না আবার অনেকে প্রাণীতে এইসব দশা কোনো একটি অনুপস্থিত থাকে। যেমন মানুষে লার্ভা ও পোষ্ট-লার্ভা দশা অনুপস্থিত। অন্যদিকে মাছের ডিম পোনা (Sac fry) লার্ভা দশা হিসেবে বিবেচিত হয়।

  • প্রাকভ্রূণীয় দশা (Pre-embryonic stage):

জাইগোট থেকে শুরু করে মরুলা (Morula) , ব্লাস্টুলা (Blastula), গ্যাস্ট্রুলা (Gastrula) ইত্যাদি পর্যায়ক্রমিক ধাপ অতিক্রম করে প্রাণী ভ্রূণে পরিণত হয়।

  • ভ্রূণ পরবর্তী দশা (Post-embryonic stage):

লার্ভা (larva), পোষ্ট-লার্ভা (post larva), অপত্য (baby), তরুণ/যুব (juvenile), পরিণত বা প্রাপ্তবয়স্ক (mature or adult) ইত্যাদি পর্যায়ক্রমিক দশা দেখতে পাওয়া যায়।

১২। পৌষ্টিকনালী (Alimentary canal):

মুখ থেকে পায়ু পর্যন্ত কোথাও সরু আবার কোথাও প্রশস্ত নালিপথকে পৌষ্টিকনালি বলে। পৌষ্টিক নালীর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে প্রাণীদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ প্যারাজোয়া, এন্টেরোজোয়া। 

  • প্যারাজোয়া(Parazoa):

প্যারাজোয়া হলো যে সকল প্রাণীর দেহে কোন পৌষ্টিক নালী থাকে না। যেমনঃ পরিফেরা পর্বভুক্ত প্রাণী।

  • এন্টেরোজোয়া(Enterozoa):

যেসকল প্রাণীর দেহে পৌষ্টিক নালী থাকে তাদেরকে এন্টেরোজোয়া বলে।যেমনঃ নিডারিয়া থেকে কর্ডাটা পর্ব পর্যন্ত সকল প্রাণী। 

১৩। সম্ভেদ বা ক্লিভেজ (Cleavage):

যে প্রক্রিয়ায় জাইগোট (zygote) ক্রমাগত মাইটোটিক কোষ বিভাজনের মাধ্যমে বিভাজিত হয়ে বহুকোষী ভ্রূণে পরিণত হয় তাকে সম্ভেদ বা ক্লিভেজ (cleavage) বলে।

জাইগোটে উপস্থিত কুসুমের পরিমাণের উপর নির্ভরকরে ক্লিভেজ সম্পূর্ণ হতে পারে আবার অসম্পূর্ণ হতে পারে। যেমন-

  • সম্পূর্ণ ক্লিভেজ (Holoblastic cleavage):

সম্পূর্ণ ক্লিভেজ আবার দু’ধরনের যথা- সমান ও অসমান। সমান ধরনের ক্লিভেজে জাইগোট বিভাজিত হয়ে সমান আকৃতির ব্লাস্টোমিয়ার উৎপন্ন করে। ইউরোকর্ডেট, মারসুপিয়াল ও অমরাবাহী স্তন্যপায়ীদের এজাতীয় ক্লিভেজ হয়ে থাকে।

অন্যদিকে অসমান ধরনের ক্লিভেজে জাইগোট বিভাজিত হয়ে অসমান আকৃতির ব্লাস্টোমিয়ার উৎপন্ন করে। ব্যাঙে এজাতীয় ক্লিভেজ দেখতে পাওয়া যায়।

  • অসম্পূর্ণ ক্লিভেজ (Meroblastic cleavage):

এ ধরনের ক্লিভেজের মাধ্যমে জাইগোটটি সম্পূর্ণভাবে বিভক্ত না হয়ে শুধুমাত্র ব্লাস্টোডিস্ক অংশটি বিভক্ত হয়। এর ফলে সমান আকৃতির কিন্তু অসম্পূর্ণ ব্লাস্টোমেয়ার সৃষ্টি হয়। এলাসমোব্রাঙ্ক, অস্থিময় মাছ, সরীসৃপ ও পাখিতে এজাতীয় ক্লিভেজ দেখতে পাওয়া যায়।

ক্লিভেজের সমতার উপর ভিত্তি করে এটি দুই প্রকার:

  • সর্পিল ক্লিভেজ (Spiral cleavage):

জাইগোটের দ্বিতীয় বিভাজনের পর তৃতীয় বিভাজনের সময় থেকেই অ্যানিম্যাল পোল (Animal pole) এর ব্লাস্টোমিয়ারগুলো ভেজিটাল পোলের (Vegetal) ব্লাস্টোমিয়ারের সাথে চক্রাকারে সামান্য স্থান পরিবর্তন করে। যেমন- নেরিসের (Nereis) ক্লিভেজ।

  • অরীয় ক্লিভেজ (Radial):

জাইগোটের পুনঃপুনঃ বিভাজনের সময় অ্যানিম্যাল পোল (Animal pole) এর ব্লাস্টোমিয়ারগুলো ভেজিটাল পোলের (Vegetal) ব্লাস্টোমিয়ারের সাথে চক্রাকারে সামান্য স্থান পরিবর্তন না করে উভয় পোলের কোষগুলো লম্বভাবে একই স্থানে অবস্থান করে। যেমন- আর্থ্রোপোডা পর্বের প্রাণীদের ক্লিভেজ।

প্রাথমিক ব্লাস্টোমিয়ারের পরিণতির উপর ভিত্তি করে ক্লিভেজ দুই প্রকার:

  • পূর্ব নির্ধারিত ক্লিভেজ (Determinate cleavage):

প্রাথমিক ব্লাস্টোমিয়ার ভ্রূণের কোন অংশ গঠন করবে তা পূর্ব থেকেই নির্ধারিত থাকে। যেমন- Ascaris, ইত্যাদি প্রাণীর ক্লিভেজ।

  • পূর্ব অনির্ধারিত ক্লিভেজ (Indeterminate cleavage):

প্রাথমিক ব্লাস্টোমিয়ার ভ্রূণের কোন অংশ গঠন করবে তা পূর্ব থেকেই নির্ধারিত থাকে না এমন ব্লাস্টোমিয়ারগুলো কোন কারণে আলাদা হয়ে গেলেও প্রতিটি ব্লাস্টোমিয়ার একটি ভ্রূণে পরিণত হতে সক্ষম। যেমন- সকল মেরুদণ্ডী প্রাণীতে এজাতীয় ক্লিভেজ দেখতে পাওয়া যায়।

১৪। অঞ্চলায়ন (Tagmatization):

প্রাণীদেহ দুই বা ততোধিক বৃহৎ অংশে তথা অঞ্চলে বিভক্ত হওয়ার বিষয়টিই হচ্ছে অঞ্চলায়ন (Tagmatization)। আর্থ্রোপোডাসহ অনেক পর্বে এরকম বিভাজন সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি অংশকে আলাদাভাবে একবচনে টাগমাটা (Tagmata) এবং একত্রে বহুবচনে টাগমা (Tagma) বলে।

চিংড়িকে দুটি বৃহৎ অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়, যথা- টাগমাটা-১ বা শিরবক্ষ (Cephalothorax) ও টাগমাটা-২ বা উদর (Abdomen)। একইভাবে মাকড়সাকেও দুটি অঞ্চলে আলাদা করা যায়। 

১৫। নটোকর্ড (Notochord):

ভ্রূণাবস্থায় অথবা আজীবন প্রানীর দেহের পৃষ্ঠ- মধ্যরেখা বরাবর অবস্থিত নমনীয়, স্থিতিস্থাপক ও ছিদ্রযুক্ত টিস্যুর দণ্ডকে নটোকর্ড বলে। এর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির উপর ভিত্তি করে প্রাণীজগতের সকল প্রাণীকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। 

  • কর্ডেট (Chorset): 

এই ধরনের প্রাণীদেহে জীবনের ভ্রূণ অবস্থায় কোন একসময় অথবা সারাজীবন নটোকর্ড উপস্থিত থাকে। মানুষ, ব্যাঙ ইত্যাদি কর্ডেট প্রাণীর উধারণ।

  • ননকর্ডেট (NonChordet):

এদীর দেহে কখনোই নটোকর্ড উপস্থিত থাকে না।  কেঁচো, মাকড়শা ননকর্ডেট  প্রাণীর উদাহরণ। 

১৬। লিঙ্গ (Sex):

পৃথিবীতে অনেক প্রাণী রয়েছে যাদের মাঝে লিঙ্গ সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত আবার অনেক প্রাণীর একই দেহে পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। সবকিছু মিলিয়ে লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে প্রাণীদের চার ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

  • লিঙ্গহীন (Sexless) প্রাণী:

এরা অযৌন জনন প্রদর্শন করে। অ্যামিবাসহ অধিকাংশ প্রোটোজোয়ানরা লিঙ্গহীন হয়ে থাকে।

  • উভলিঙ্গ (Monoecious) প্রাণী:

এদের একই প্রাণীদেহে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় বৈশিষ্ট্যই উপস্থিত থাকে। উভয় বৈশিষ্ট্য একই সময়ে প্রকাশিত হতে পারে আবার ভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হতে পারে। প্লাটিহেলমিনথিস পর্বের অনেক প্রাণী ও কেঁচোসহ অনেক অ্যানিলিডস উভলিঙ্গ হয়ে থাকে। 

  • একলিঙ্গ (Dioecious) প্রাণী:

এদের ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীদেহে পুরুষ ও স্ত্রী বৈশিষ্ট্য আলাদাভাবে উপস্থিত থাকে। অর্থাৎ এদের পুরুষ ও স্ত্রী একই প্রজাতির দুটি ভিন্ন সদস্য।

  • নপুংসক প্রাণী:

এই প্রাণীরা অকার্যকর প্রজনন অঙ্গ বিশিষ্ট পুরুষ হতে পারে আবার নারীরাও হতে পারে। পুরুষ বা নারী যে বৈশিষ্ট্যই উপস্থিত থাক না কেন এদের প্রজনন অঙ্গ ক্ষয়িষ্ণু তথা অক্ষম বা অকার্যকর।

শেয়ার:

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × 3 =